একই ধাতু হইতে ক্ষমা ও ক্ষমতা শব্দ দুইটির উৎপত্তি— ‘ক্ষম্’। কিন্তু হায়, এ যুগের রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনরা সংস্কৃত জানেন না। কেবল এইটুকু জানেন, ক্ষমতা দিয়া অপর পক্ষকে নিষ্পেষিত করিয়া তাহাদের ক্ষমা আদায় করিয়া ছাড়িতে হয়। তাহাই জয়, তাহাতেই ক্ষমতার শান্তি। তাণ্ডব ওয়েব সিরিজ় লইয়াও তাহাই হইল। সমাজমাধ্যমে বয়কট ও প্রবল আক্রমণ, বাহিরেও ক্ষমতার তাণ্ডব। হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত হইয়াছে, এই অভিযোগে নির্মাতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর হইল, প্রধান অভিনেতার বাড়ির বাহিরে পুলিশ পাহারা বসাইতে হইল। বিজেপির বহু নেতা সিরিজ় নিষিদ্ধ করিবার দাবি তুলিলেন, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা নির্মাতাদের হুমকি দিলেন— ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের মূল্য চুকাইতে প্রস্তুত থাকুন। নির্মাতারা নিঃশর্ত ক্ষমা চাহিয়াছেন। ক্ষমতার নিকট ক্ষমা চাহিলে গা বাঁচিয়া যায়, বাণিজ্যও।
আজিকার ভারতে এই তাণ্ডব নূতন নহে। কয়েক বৎসর পূর্বের পদ্মাবত, বা কিছু দিন আগের আ সুটেবল বয়-এর কথা মনে পড়িতে পারে। রাজপুত রানি মুসলমান বাদশার কাছে ঘেঁষিতে পারিবেন না, এমনকি স্বপ্নদৃশ্যেও। মন্দিরমধ্যে দুই ধর্মের দুই প্রণয়ী অন্তরঙ্গ হইতে পারিবে না, কাহিনির প্রয়োজনে হইলেও। শিব বা অন্য হিন্দু দেবদেবী লইয়া চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ়ের কল্পিত চরিত্রের মুখেও বেসুর বাজিতে পারিবে না। তাবৎ ভাবাবেগ আহত হইবার জন্য মুখিয়া আছে। তাণ্ডব লইয়া ক্ষমতার তাণ্ডব-আবহে অগণিত দর্শক সমাজমাধ্যমে জানাইয়াছেন, যাহা হইতেছে তাহা নিতান্ত হাস্যকর ও অনভিপ্রেত, কারণ সিরিজ়ে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা ভাবাবেগ আহত করিবার মতো কিছুই নহে; তদুপরি যে চরিত্র বলিতেছে এবং যে পরিপ্রেক্ষিতে বলিতেছে, দুই-ই মনগড়া। দিনশেষে বিনোদন ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্য তাহাদের নাই। বস্তুত, পর্দায় যাহা দেখা বা শুনা যাইতেছে, তাহা প্রকৃতপক্ষে কাল্পনিক, ব্যক্তি বা ঘটনাবিশেষের সহিত তাহার সাদৃশ্য নেহাত সমাপতন, এই কথাগুলি দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে শুরুতেই ভাসিয়া উঠে। তাহার পরেও যখন নির্মাতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়, অভিনেতার বাড়ি সুরক্ষিত রাখিতে পুলিশ ডাকিতে হয়, একটি দৃশ্য বা কিছু অপ্রিয় সংলাপের জন্য সমগ্র বিনোদনবস্তু ও তাহার সম্প্রচার-পরিসরকেই নিষিদ্ধ করিবার জিগির উঠে, তখন বুঝিতে হয়, ইহা আসলে ক্ষমতার রাজনীতির পেশি ফুলাইবার ইচ্ছাপূরণ। ভাবাবেগ রক্ষা উপলক্ষ মাত্র, আসলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষমতার হাত না চালাইলে তাহার চলে না।
ভাবাবেগ ব্যাপারটিও প্রণিধানযোগ্য। ভাবাবেগ বলিয়া যাহা বুঝানো হইতেছে তাহা প্রকৃতই ভাবাবেগ, না কি কুসংস্কার, দুইয়ের মধ্যে রেখাটি এত সূক্ষ্ম যে ঠাহর করা মুশকিল। তদুপরি, ভাবাবেগের আধারও ইদানীং পাল্টাইয়া গিয়াছে। পূর্বে ভাবাবেগ বলিতে জাতি, ধর্ম, দৃশ্যমানতা বা গুরুত্বের দিক দিয়া সংখ্যালঘু মানুষের আবেগ-অনুভূতি বুঝাইত, ক্ষুদ্র বলিয়াই তাহাদের রক্ষা করিবার দায়িত্বটি সমষ্টি কাঁধে তুলিয়া লইত। এখন ভাবাবেগ হইয়া উঠিয়াছে সংখ্যাগুরুর সম্পত্তি, উঠিতে বসিতে তাহার আঘাত লাগিতেছে, নামিয়া আসিতেছে প্রত্যাঘাত। এই ভাবাবেগের মূলে দগদগ করিতেছে চরম অনৈতিকতা। ভঙ্গুর অথচ আপাদমস্তক সহিংস এই ভাবাবেগ গণতন্ত্রের কোন কাজে আসিবে?