আঁচটা এ বার ঘরের হাতার কাছেই এগিয়ে এসেছে। আবার সেই গণধর্ষণ। আবার সেই ধর্ষণের পরে পুড়িয়ে খুন।
হায়দরাবাদে মহিলা পশু চিকিৎসক প্রিয়ঙ্কা রেড্ডিকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার বীভৎসতা এখনও জনমানসে তাজা। তারই মধ্যে পরের ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে এই রাজ্যেই, উত্তর দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে ধর্ষণকারীরা।
খবরে প্রকাশ, গত সোমবার ওই নাবালিকার দগ্ধ দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে কুমারগঞ্জের সাফানগর ও অশোকগ্রামের মাঝে ফাঁকা মাঠে একটি কার্লভাটের নীচে। শেয়াল-কুকুরে তার দেহের কিছু অংশ খুবলে খেয়েও ফেলেছে ততক্ষণে। তদন্তে নেমে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতারও করেছে। পুলিশের দাবি, তাদের এক জন কিশোরীটির ‘প্রেমিক’। রবিবার সন্ধ্যায় সে মেয়েটিকে নিজের গ্রাম থেকে আট কিলোমিটার দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার চালায়। দুই বন্ধুও তার সঙ্গে ছিল। গণধর্ষণের পরে মেয়েটির গলায়, পেটে, হাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। মেয়েটি মারা গেলে মোটরবাইকের পেট্রল বের করে তার দেহ জ্বালিয়ে দেয় তারা। এ দেশে ধর্ষিতার মায়ের বুকফাটা কান্না কুঁড়েঘরে ফসিল হয়ে যায়। টিভির পর্দায় আর খবরের কাগজে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বা ‘কন্যাশ্রী’-র বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে যায় নারী নির্যাতনের নানাবর্ণ খবর। ধর্ষণের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এলে রাস্তার মঞ্চ থেকে বিধানসভা বা সংসদে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে গলার শিরা ফুলিয়ে টেবিল চাপড়ে হইচই করেন রাজনীতির কারবারিরা। গণমাধ্যম সরব হয়, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ কয়েক দিন লম্ফঝম্প করে। তার পর সব থিতিয়ে যায়। মিছিলে মোমবাতির আলো নেভে। কামদুনি, দিল্লি, উন্নাও, তেলঙ্গানা, কুমারগঞ্জ — ধর্ষিতের মিছিল ক্রমশ দীর্ঘতর হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয় ৭ থেকে ১২ বছর বয়সি মেয়েরা। প্রায় প্রতিদিন দেশের আনাচাকানাচে আখছার ধর্ষণ হয়ে চলেছে। গত বছরের প্রথম ছ’মাসে এ দেশে ২৪ হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তবে সম্ভবত শুধু পরিসংখ্যান দিয়েও বীভৎসতার গভীরতা বিচার করা যাবে না।
মনে রাখতে হবে, এই সমাজ ক্ষমতাধরদের দুর্বলকে নিপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে বলেই অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, ধর্মীয় রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অথবা/ এবং পারিবারিক জটিলতা, সেই সঙ্গে এবং সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও গ্রেফতারের সংখ্যা নগণ্য। অনেক সময়ে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ধর্ষকেরা আবার আরও বেশি উৎসাহে একই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অপরাধ করেও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিসম্পন্নেরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছে
আবার যারা অপরাধ করেছে, তারাই উল্টে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে উল্টে ধর্ষিতার চরিত্র ও পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমতাবস্থায় আইন ও বিচার ব্যবস্থার জটিল আবর্তে বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ যখন সন্দেহভাজনের বেআইনি ‘এনকাউন্টার’ হত্যায় হাততালি দেয়, অবাক হওয়া যায় না। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের প্রাক্কালেও সমাজ বা রাষ্ট্র মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক মাপকাঠিতে ছেলেমেয়ে তুল্যমূল্য শুধু সরকারি প্রচারেই, বাস্তবে তার প্রতিফলন কার্যত নেই। বরং ‘নির্মল বাংলা’ বা ‘স্বচ্ছ ভারত’-এ ঘরে-বাইরে লিঙ্গ বৈষম্যের কুৎসিত চেহারাটাই প্রকট হয়ে উঠেছে।
মেয়েদের উপরে আক্রমণটা অবশ্য শুরু হয় জন্মের আগে থেকেই। গর্ভাবস্থাতেই কন্যাভ্রুণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গর্ভপাতের কাঁচি এড়িয়ে কন্যাসন্তান যদিও বা ভূমিষ্ঠ হয়, তার পরেও চলে মুখে নুন চাপা দিয়ে তাকে মারার চেষ্টা। সেই বিপদও যদি তার কাটে, সেই মেয়ে যদি হাতে-পায়ে বেড়ে উঠতে থাকে, শুরু হয় শ্বাপদের চোখের নজরদারি। অজানা ধর্ষকের হিংস্র চোখ তাকে রাত-দিন মাপতে থাকে। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময়ে আশঙ্কিত, সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন তার বাবা-মা।
রাষ্ট্র তখন কী করে?
আজব দেশে শিশু ধর্ষণের মতো গজব ঘটনা রোধে তেলঙ্গানার চিরকুর বালাজি মন্দিরে যখন গরু পুজো হয়, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’য় সভ্যতার নিক্তিতে আদৌ কি আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করতে পারি? আইনের শাসন কায়েম করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ। কী শাসন রয়েছে এই দেশে? ইউক্রেনের পার্লামেন্টে আইন পাশ হয়েছে যে ধর্ষক বা যৌন নির্যাতনকারীর বয়স যদি ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হয়, শাস্তি হিসাবে তাদের নপুংসক করে দেওয়া হবে। কাজাখস্তানে ধর্ষকদের রাসায়নিক ভাবে খোজা করে দেওয়ার শাস্তি প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। দিল্লিতে নির্ভয়ার চার ধর্ষককে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে। কিন্তু তার পরেও ধর্ষণ রোখা যাচ্ছে কী?
শুধু আইন করে আর কড়া শাস্তির চোখরাঙানিতে এই যুগ-যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক শয়তানির অবসান হবে, এমন আশা করা দুষ্কর। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ঝেড়ে ফেলে দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনই দরকার ছোট থেকেই নারীর মর্যাদা সম্পর্কে আপামর পুরুষদের সচেতন করা। দুর্ভাগ্যের কথা, এখনও স্কুলের পাঠক্রমে জীবনশৈলী অচ্ছ্যুৎ। ছেলে হোক বা মেয়ে, সুস্থ সংবেদনশীল নাগরিক তৈরি করতে বাড়ি, স্কুল তথা সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শেখাতে হবে। বোঝাতে হবে, বিপদটা শুধু মেয়েদের নয়, লিঙ্গ নির্বিশেষে গোটা দেশের, গোটা সমাজের। তাদের মা-বোনদেরও।
(সঙ্গের ছবিটি ঘটনাস্থলের)
শিক্ষক, শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় করিমপুর, নদিয়া