রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ শীর্ষক বক্তৃতা-প্রবন্ধে ইংরাজি ‘ওরিজিন্যালিটি’র প্রতিশব্দ হিসাবে একটি শব্দ ব্যবহার করিয়াছিলেন: অনন্যতন্ত্রতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে এই বিরল গুণটি কী ভাবে মূর্ত হইয়াছিল, তাহার অসামান্য বিশ্লেষণের জন্য ভাষণটি আজও অত্যন্ত মূল্যবান। তিন বছর পরে লিখিত একই শিরোনামের আর একটি প্রবন্ধে তাঁহার মন্তব্য: ‘তিনি গতানুগতিক ছিলেন না, তিনি স্বতন্ত্র, সচেতন, পারমার্থিক ছিলেন; শেষ দিন পর্যন্ত তাঁহার জুতা তাঁহার নিজেরই চটিজুতা ছিল।’ তরুণ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরচরিতের মূল বৈশিষ্ট্যটি নির্ভুল প্রজ্ঞায় চিনিয়াছিলেন। আজ, জন্মের দুই শত বৎসর পরেও, তাঁহার চরিত্রের স্বতন্ত্রতা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তাহার কারণ, বিদ্যাসাগরের প্রত্যয়ী স্বাধীনচিত্ততা যে ‘পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা’ এবং ‘বাঙালিজীবনের জড়ত্ব’কে সবলে ভেদ করিয়া উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে অগ্রসর হইয়াছিল, সেই ক্ষুদ্রতা এবং জড়ত্ব এই মুহূর্তের বঙ্গসমাজে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছে। বিদ্যাসাগর তাঁহার সমকালীন সমাজে যতটা স্বতন্ত্র এবং নিঃসঙ্গ ছিলেন, বর্তমান সমাজে তাহার দ্বিগুণ স্বতন্ত্র ও নিঃসঙ্গ বোধ করিতেন। বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী কেবল ইতিহাসের দায় মিটাইবার উপলক্ষ নহে, বাঙালির গভীর এবং নির্মম আত্মসমীক্ষার ক্ষণ। রবীন্দ্রনাথ যদি বাঙালিকে তাঁহার বিদ্যাসাগরচরিত একটি দর্পণ হিসাবে উপহার দিয়া থাকেন, তবে সেই দর্পণ আজও অমলিন।
বাঙালি সাধারণ ভাবে করুণাসাগর বিদ্যাসাগরকে দূর হইতে প্রণাম করিয়া দূরেই রাখিয়াছে, তাঁহার ব্যক্তিত্বকে আত্মস্থ করিতে চাহে নাই, সম্ভবত সেই ব্যক্তিত্বকে আপন ক্ষুদ্র আধারে ধারণ করিতে পারিবে না জানিয়াই। অথচ স্তবের বাণীর আড়াল টানিয়া তাঁহাকে ঢাকিবার সময় সে মনে রাখে নাই যে, ওই বাণীর গভীরেই নিহিত রহিয়াছে তাঁহার অনন্যতন্ত্রতা— বিদ্যাচর্চার প্রতি অলোকসামান্য আগ্রহ এবং সমাজের অন্যায় অনাচারের পীড়নে যন্ত্রণাদীর্ণ মানুষের প্রতি অপার করুণা, এই দুইয়ের সমন্বয় তাঁহার সমগ্র জীবনকে চালনা করিয়াছে। এই দুই ধর্মকে কোনও ভাবেই পরস্পরবিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার উপায় নাই। এক দিকে বাংলা ভাষা এবং বঙ্গবাসীর শিক্ষার প্রসারে তাঁহার ভগীরথপ্রতিম ভূমিকা, অন্য দিকে সমাজসংস্কারের লক্ষ্যে কার্যত একক আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার সাধনা— উভয় ক্ষেত্রেই তাঁহাকে তাড়না করিয়াছে সমাজ-হিতৈষা, সেই কঠিন সংগ্রামে প্রকরণ হিসাবে কাজ করিয়াছে তাঁহার অগাধ বিদ্যা এবং প্রখর মেধা।
জ্ঞানচর্চার প্রতি অপার আগ্রহ এবং সমাজের প্রতি নিঃশর্ত করুণার এই সমন্বয়কে কর্মযোগে প্রয়োগ করিবার কঠিন ব্রতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যে গুণটির বিরাট ভূমিকা সচরাচর অনুচ্চারিত থাকিয়া যায়, তাহার নাম বাস্তববাদিতা। তিনি আপন সমাজের পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল এবং সচেতন ছিলেন। জানিতেন, বিদেশি শাসনের শাসিত একটি দেশে এবং অতিমাত্রায় রক্ষণশীল একটি সমাজে তাঁহাকে প্রতি পদে অজস্র বাধা অতিক্রম করিয়া আপন পথে চলিতে হইবে। শাসকের সাহায্য লইয়া প্রয়োজনীয় আইনি পরিবর্তন সাধন করিতে হইবে। শাস্ত্রকে ব্যবহার করিয়া সামাজিক সংস্কারের পক্ষে প্রয়োজনীয় যুক্তি সংগ্রহ করিতে হইবে। প্রথমেই সার্বিক শিক্ষার অ-সম্ভব আকাঙ্ক্ষা ছাড়িয়া স্কুলকলেজ প্রতিষ্ঠার বাস্তবোচিত পরিকল্পনা করিতে হইবে। বাস্তবের প্রতি এই কার্যকর আগ্রহও এই মুহূর্তে বঙ্গসমাজের পক্ষে বিশেষ ভাবে শিক্ষণীয়। অনেক কথা বলিয়া কোনও কাজই না করিবার যে অভ্যাস এই সমাজ আপন স্বভাবে পরিণত করিয়াছে, তাহা ভাঙিতে না পারিলে বিদ্যাসাগরকে উদ্যাপন করিয়া লাভ নাই। ইহাই প্রথম ভাগ।