ভারতীয় গণতন্ত্র অনেক সময়েই নিজের শক্তি ও সামর্থ্য লইয়া আত্মগৌরবে আলোকিত হইয়া বসিয়া থাকে। এই মুহূর্তেই তেমন বহু গৌরব-বাচন দিকে দিকে শ্রুত হইতেছে। জনসংখ্যার দিক দিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে আসিয়া পা রাখিতেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এমন প্রচার দুর্বার হইয়াছে গত কয়েক দিন ধরিয়া, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদীর স্বরাজ্যে। মুশকিল হইল, যে সকল ভিত্তির উপর ভর করিয়া কোনও ব্যবস্থা ‘গণতন্ত্র’ হিসাবে সফল ও সার্থক হয়, বর্তমান কালে ভারতে কিন্তু তাহার অনেকগুলি লইয়াই প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়াছে। এই সব ভিত্তির মধ্যে একটি হইল বিচারব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে দূরত্ব, এবং দুইটি বিভাগের আপাত-স্বাধীনতা। এক দিকে যখন গণতন্ত্র তাহার নিজের পিঠ চাপড়াইতেছে, অন্য দিকে সংশয়— দুই বিভাগের মধ্যে এই দূরত্ব ক্রমশ বিপজ্জনক ভাবে কমিতেছে না তো? গত সপ্তাহের শেষে এই প্রশ্ন আবারও সামনে চলিয়া আসিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রের কারণে। দিল্লিতে এক আন্তর্জাতিক অধিবেশনে বিচারপতি মিশ্র ভূয়সী প্রশংসার বাক্যাবলি উচ্চারণ করিলেন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে। বলিলেন যে, মোদী হইলেন ‘জিনিয়াস’, বহুগুণসম্পন্ন গুণী ব্যক্তি। বলিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী বিশ্ব-রাজনীতিতেও পথ-প্রদর্শক, তাঁহার দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারত এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক অতীব দায়িত্ববান ও মিত্রভাবাপন্ন রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন গুণকীর্তন তাঁহার ভক্ত বা অনুরাগীদের মুখে বিস্তর শোনা যায়। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিও ব্যক্তিগত ভাবে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এমন উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেই পারেন। তাহা প্রকাশ্যে উচ্চারণে কোনও আইনি বাধাও নাই। কিন্তু প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে আইনের নহে, শোভনতার। এবং প্রশ্ন নৈতিকতারও, যে নৈতিকতা গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য ভিত্তি। আদালত ও বিচারপতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও বলিতেই হয়, এমন উচ্চারণ তিনি না করিলেই ভাল হইত।
এই সংশয়ের প্রেক্ষাপটটিও লক্ষণীয়। রাজনৈতিক বলয়ের ঢেউ আসিয়া লাগিতেছে বিচারবিভাগের কাজেকর্মে— এই আশঙ্কা নিকট অতীতে সুপ্রিম কোর্টের অন্দর হইতেই ভাসিয়া আসিয়াছে। মাননীয় বিচারপতিদের অভিযোগ জানাইতে দেখা গিয়াছে সংবাদমাধ্যমের কাছে। তাঁহাদের সেই পদক্ষেপ ঠিক ছিল না ভুল, তাহা লইয়া বিতর্ক বাধিয়াছে। সাধারণ ভাবে দেখিতে গেলে এই পদক্ষেপে সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ব্যাহত হইবার কথা। তবু প্রতিযুক্তিটিও গুরুতর যে, গণতান্ত্রিক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও নিরপেক্ষতা এমনই একটি নিরন্তর সাধনার বিষয় যে ভিতর হইতেই আত্মসমালোচনার স্বর উঠিলে প্রতিকারের সম্ভাবনাও বাড়ে। সত্য কথা বলিতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত ভারতীয় সমাজ সর্বতো ভাবেই তাহার বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতার উপর নির্ভরশীল। তাহার সামান্যতম ব্যত্যয় বা ব্যত্যয়ের আশঙ্কাও গভীর উদ্বেগের কারণ।
একটি কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার। সমস্যাটি নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতির রং লইয়া নহে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু বা মনমোহন সিংহের সম্পর্কেও যদি তদানীন্তন বিচারপতিরা এমন ভূয়সী প্রশংসায় বাঙ্ময় হইতেন, তাহা একই রকম উদ্বেগজনক হইত। যে কোনও ভাবেই হউক, বিচারবিভাগকে রাজনৈতিক জোয়ার-ভাটার অনেক উপরে থাকিতে হইবে। বাহির হইতে জনসমাজ এইটুকু প্রার্থনার অধিক আর কিছুই করিতে পারে না। বিচারবিভাগকেই ভাবিতে হইবে, কী ভাবে আত্মসংশোধনের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। বিচারপতিদের জন্য কোনও আচরণবিধি তৈয়ারি করার প্রয়োজন আছে কি না, তাহা বিবেচনার অধিকারও তাঁহাদেরই। কিন্তু বিবেচনা জরুরি, ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি।