ছিল রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ়, হইয়া গেল হ য ব র ল। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু যে আত্মহত্যা নহে, খুন— বিহার ভোটের পূর্বাহ্ণে তাহা প্রমাণ করিবার তাড়নায় যে ‘তদন্ত’ আরম্ভ হইয়াছিল, সিবিআই, ইডি ইত্যাদি ঘাট ছুঁইয়া তাহার জল এখন গাঁজা কেসের খাতে বহিতেছে। প্রয়াত অভিনেতার বান্ধবীকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। বলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রীর ডাক পড়িতেছে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর জেরায়। আরও বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর নামও ড্রাগ তদন্তে শোনা যাইতেছে, এবং ‘ঘটনাচক্রে’, তাঁহাদের কেহই শাসক শিবিরের অতি-ঘনিষ্ঠ নহেন। এক পরিচালকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠিয়াছে— তিনিও, ‘ঘটনাচক্রে’ই, প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সমালোচক। দুর্জনে বলিতে পারে, এক অস্ত্রে দুই লক্ষ্য ভেদ করিতেছেন দিল্লির অধীশ্বররা। শীর্ষ অভিনেত্রী বা পরিচালকের বিরুদ্ধে রোমাঞ্চকর অভিযোগ উঠিলে, এবং বিশেষত তদন্ত প্রক্রিয়ার অতি গোপন খবর নিয়মিত গণমাধ্যমে ‘ফাঁস’ হইয়া গেলে, দেশের সিংহভাগ মানুষ তাহা লইয়াই মাতিয়া থাকিবেন। বেহাল অর্থনীতি, ধরাশায়ী স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কৃষক স্বার্থবিরোধী আইন ইত্যাদি লইয়া মাথা ঘামাইবার অবকাশ তাঁহাদের থাকিবে না। অন্য দিকে, যে অভিনেত্রী জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রদের পার্শ্বে দাঁড়াইবার দুঃসাহস দেখাইতে পারেন, যে পরিচালক প্রশ্ন করিতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্বেষনীতিকে, তাঁহাদের উচিত শিক্ষাও দেওয়া হইবে। অতএব, রুমালটি অকারণে বিড়াল হইয়া উঠে নাই— সুশান্ত সিংহ রাজপুতের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি যত গ্রহণযোগ্যতা হারাইয়াছে, ততই ভিন্নতর স্ট্র্যাটেজির গুরুত্ব বাড়িয়াছে।
বস্তুত, এই ঘটনাপ্রবাহের দুইটি অভিমুখই পরিচিত। অর্থনীতি বা রাজনীতির মূল প্রশ্নটিকে আড়াল করিতে অবান্তর, কিন্তু বিতর্কিত প্রসঙ্গকে জনসমক্ষে লইয়া আসা জনসংযোগের একটি কৌশল। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের ছয় বৎসরে সেই কৌশলের বহুবিধ ব্যবহার দেখিয়াছে ভারত। অর্থনীতি ভূলুণ্ঠিত, এই অবস্থায় তিনি কখনও যোগব্যায়ামের ছবি শেয়ার করেন, কখনও ময়ূরের ভিডিয়ো। মানুষের নজরও ঘুরিয়া যায়। চাষির যখন নাভিশ্বাস উঠে, তিনি পাঁচ বৎসরে কৃষি-আয় দ্বিগুণ করিবার প্রতিশ্রুতি দেন। এবং, অবিলম্বে তর্কটিও বর্তমান হইতে ভবিষ্যতের পরিসরে পৌঁছাইয়া যায়। ইহা কি নিতান্তই সমাপতন, যে অর্থনীতির ২৪ শতাংশ সঙ্কোচনের সংবাদটি সাধারণ মানুষের কাছে ঢাকা পড়িয়া গেল সুশান্ত-রিয়া-দীপিকা-অনুরাগ সংক্রান্ত তর্কে? জিডিপি অপেক্ষা বলিউড সহজবোধ্য; আর্থিক সঙ্কটের তুলনায় রুপালি পর্দার তারকাদের কুনাট্য অধিক মনোগ্রাহী। তদুপরি, সংবাদমাধ্যমের একাংশ সরকারের সানন্দ সহযোগী। ফলে, যাহা চলিতেছে, তাহা মানুষের মনোযোগ ঘুরাইয়া দেওয়ার প্রক্রিয়া, এই অভিযোগ উড়াইয়া দেওয়া কঠিন।
এই মওকায় বিজেপি শত্রুদমন করিতেছে, এই অভিযোগটিও কি সারবত্তাহীন? ভীমা-কোরেগাঁও হইতে দিল্লির হিংসাকাণ্ড, সব ক্ষেত্রেই ‘তদন্ত’ যে ভঙ্গিতে অগ্রসর হইয়াছে, এবং যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচকদের অভিযুক্ত ঘোষণা করা হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ হওয়া সঙ্গত যে, সরকার তদন্তকারী সংস্থাকে কাজে লাগাইয়া বিরোধীদের দমন করিতেই তৎপর। প্রশ্ন উঠিতেছে, দীপিকা যদি জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীদের পার্শ্বে না দাঁড়াইতেন, তবে কি সুশান্ত-মামলার মোড় তাঁহার দিকে ঘুরিত? বস্তুত, এই মামলায় আর কাহার নাম জড়াইবে, তাহার সম্ভাব্য তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরিতেছে এবং তাহাতে অন্তর্ভুক্তির একমাত্র শর্ত, সেই তারকা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচক। সরকারের প্রতি, প্রশাসনের প্রতি এই সুগভীর অবিশ্বাস ভারতীয় গণতন্ত্রের কত বড় ক্ষতি করিতেছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী ভাবিয়া দেখুন।