জগদীপ ধনখড়। —ফাইল চিত্র
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করিয়া যাহা ঘটিল, তাহা দুর্ভাগ্যজনক। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে লইয়া ছাত্রদের বৃহদংশের মধ্যে ক্ষোভ কেন, তাহা বোঝা সম্ভব। রাজ্যপাল নিজের সাংবিধানিক পদের মর্যাদা রক্ষা করিতেছেন কি না, সেই প্রশ্নও জরুরি। অনেক ছাত্রছাত্রী বোধ করিতে পারেন যে আচার্যের পদে কোনও নিরপেক্ষ বিদ্বজ্জন থাকিলে ভাল হইত। এমনকি, রাজ্যপাল হইলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও হইবেন, কেহ এই ব্যবস্থাটিকেও প্রশ্ন করিতে পারেন। প্রশ্নগুলি অযৌক্তিক নহে, আপত্তিগুলিও উড়াইয়া দেওয়ার কোনও কারণ নাই। কিন্তু, ব্যক্তি হিসাবে জগদীপ ধনখড় যেমনই হউন, ঘটনা হইল যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সমাবর্তনের দিন আচার্য উপস্থিত থাকিলে তিনিই ডিগ্রিপ্রাপকদের হাতে অভিজ্ঞানপত্র তুলিয়া দিবেন, তাহাই প্রথা। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা যে ভঙ্গিতে সেই প্রথা ভঙ্গ করিলেন, তাহা অতি দুর্ভাগ্যজনক। প্রথা বস্তুটির হাতে আত্মরক্ষার অস্ত্র নাই, অন্যদেরই তাহাকে রক্ষা করিতে হয়। এবং, রক্ষা করিতে পারিবার মধ্যেই গৌরব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সেই গৌরব হারাইলেন। তাহাতে রাজ্যপালের অপমান হইল— কিন্তু, বলিতে নাই, তিনি কার্যত প্রত্যহ ‘অপমানিত’ বোধ করিয়াই থাকেন— নজরুল মঞ্চের ঘটনায় প্রকৃত অপমান হইল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের, পশ্চিমবঙ্গের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কথাও উল্লেখ করা বিধেয়। সেখানেও কার্যত একই ঘটনা ঘটিয়াছিল। ছাত্রছাত্রীরা ভুলিলেন, রাজ্যপাল নিমিত্তমাত্র— সমাবর্তনের দিনটি প্রকৃত প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত ডিগ্রিপ্রাপক ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কের একটি ধাপের ইতি, এবং পরবর্তী ধাপের সূচনালগ্ন। এক অর্থে দিনটি পবিত্রতম— ছাত্রছাত্রীদের জন্যও বটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও। সেই দিনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-হেন অসম্মান ঘটাইবার অধিকার ছাত্রছাত্রীদের আছে কি না, তাঁহারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
রাজ্যপালের সাম্প্রতিক ভূমিকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রেরা বলিতে পারেন, তবে কি প্রতিবাদের পরিসর থাকিবে না? অবশ্যই থাকিবে। এমনকি, সমাবর্তনের দিনটিকেও প্রতিবাদের স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব। কী ভাবে তাহা করিতে হয়, সেই পথ খুঁজিতে হইলে যাহা প্রয়োজন, তাহার নাম রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়িবার জন্য অহিংসা আর সত্য যে হাতিয়ার হইতে পারে, এই কথাটি গাঁধীর রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি ব্যতীত হয়তো অজানাই থাকিত। আবার, একনায়কতন্ত্রী শাসনের সাঁজোয়া গাড়ির পথ রোধ করিয়া দাঁড়ানো যায়, এবং গোটা দুনিয়ার সম্মুখে দেশের দমনপীড়নের বাস্তব মেলিয়া ধরা যায়, তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের ‘ট্যাঙ্ক ম্যান’ তাহা দেখাইয়া দিয়াছিলেন। মাত্র গত মাসেই দিল্লির প্রতিবাদী তরুণেরা পুলিশের হাতে ফুল তুলিয়া দিয়া নিজেদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করিয়াছিলেন। উদাহরণের তালিকা বাড়ানো অনর্থক— মূল কথা হইল, রাজ্যপালের গাড়ি ঘিরিয়া, ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিয়া তাঁহাকে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য করাই প্রতিবাদের একমাত্র পথ ছিল না। বস্তুত, এই পথটিই ছিল সহজতম। এই পথে হাঁটিতে রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির প্রয়োজন ছিল না, চিন্তার প্রয়োজন ছিল না। ইহা পরিচিত পথ। ছাত্রেরা সেই সহজতম বিকল্পটি বাছিয়া লইয়া নিজেদের নৈতিক উচ্চ অবস্থান হারাইলেন। সর্বাধিপত্যকামী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁহারা গণতন্ত্রের সমর্থনে পথে নামিয়াছেন। অথচ, তাঁহাদের প্রতিবাদের ভঙ্গিটি অবিকল সেই শাসকদের ন্যায়— যাঁহাকে পছন্দ নহে, সর্বশক্তিতে তাঁহার কণ্ঠরোধ করা। ছাত্রেরা ভাবিতে পারিতেন, কোন পথে হাঁটিলে রাজ্যপালের প্রতি তাঁহাদের যাবতীয় অসন্তোষ স্পষ্ট প্রকাশ পাইত, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্মান হইত না। শিক্ষা তো ভাবিতেই শেখায়।