অধিকার: বিরোধী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের বক্তৃতা ব্রিগেডে, কলকাতা, ৫ জুন ১৯৭৫।
গত বৃহস্পতিবার ছিল ২৫ জুন। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা ঘোষণার ৪৫ বছর পূর্তি। প্রধানমন্ত্রী সে দিন একটি বিশেষ বার্তা দিলেন। বললেন, সে দিন ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের জন্য ভারতীয় নাগরিকের লড়াই ভুলবে না কেউ। তাঁরা গণতন্ত্রকে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁদের কুর্নিশ!
খুব দরকারি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। ঠিকই, ১৯৭৫ সালে ভারত যেন হঠাৎ করে এক অপ্রত্যাশিত অভাবনীয়ের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। কিছু দিনের জন্য স্বাধীন দেশের চেনা আবহাওয়া উবে গিয়ে পরাধীনতার স্বাদ এসে গিয়েছিল। সাংবিধানিক অধিকার চলে যাচ্ছিল। তালিকা হচ্ছিল, কে কে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, কাজ করছেন। সাংবাদিক বা লেখকরা পড়ছিলেন গ্রেফতারের খাঁড়া, আর হুমকির রক্তচোখের সামনে। তার মধ্যেও অনেকে ভয় পাননি, হাল ছাড়েননি, যে কোনও দাম দিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়তে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের জন্যই ভারত শেষ পর্যন্ত ভারত থেকেছিল, পাকিস্তান বা চিন হয়ে যায়নি।
জরুরি অবস্থার নেপথ্যের গল্পটাও অবশ্য ভুলে গেলে চলবে না। জটিল রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে নির্বাচিত ইন্দিরা গাঁধী সরকারকে বিপুল উদ্বেগে ফেলে দিয়েছিলেন এক বিরোধী নেতা, যাঁর আন্দলনের মেজাজটা বুঝে নেওয়া যায় আন্দোলনের নামটি থেকেই, ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’। ‘টোট্যাল রেভোলিউশন’ ছিল লক্ষ্য। জয়প্রকাশ নারায়ণ কী চাইছিলেন, তার আন্দাজ মিলতে পারে বিহারে তখনকার রেলওয়ে মন্ত্রী এল এন মিশ্রর বোমায় মৃত্যু, কিংবা সরকারকে সম্পূর্ণ অচল করে দিতে জে পি-র দিল্লিতে আন্দোলনের ডাক (২৩ জুন), প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির মধ্যে ক্ষুব্ধ জনতাকে ঢুকিয়ে ধ্বংসের ডাক, এ সব থেকে। মোরারজি দেশাই পরে বলেছিলেন, ‘‘আমরা ওঁকে (ইন্দিরা) আসন থেকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। ... হাজারে হাজারে মানুষ জড়ো হয়ে ওঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে দিনরাত পদত্যাগের স্লোগান দিয়ে ওঁর কাজকর্ম স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম।’’
অসম্ভব ছিল না সে দিন এই কাজ। মানুষের মেজাজমর্জি তখন উত্তপ্ত। আগের দু-এক বছর ধরে চলছে নানা হিংসাত্মক ঘটনা। ১৯৭৩ সালে আমদাবাদের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্ররা প্রতিবাদ-আন্দোলন চালানোর সময় পুলিশ দমন করতে এলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়, নানা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রবিক্ষোভের আগুন। আমদাবাদে নেমে আসে চরম নৈরাজ্য, সেনা নামাতে হয় সরকারকে। এ দিকে বিহারে তখন একের পর এক ধ্বংসকাণ্ড। এবিভিপি ও অন্যান্য ছাত্র দলের হাতে জ্বলছে একের পর এক সরকারি বিল্ডিং, এমনকি সংবাদপত্র অফিস। বিদ্রোহের হাল ধরতে নেমে আসেন এক শ্রদ্ধেয় প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা, জয়প্রকাশ নারায়ণ। দ্রুত তৈরি হয়ে উঠছেন অল্পবয়সি নেতারাও। অরুণ জেটলি গোটা ১৯৭৪ সাল জুড়ে পটনা এবং আমদাবাদ দুই বিক্ষোভনগরেই বিশেষ সক্রিয় ছিলেন, ১৯৭৫-এর জুন মাসে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭৩-৭৪ সালে গুজরাতের নবনির্মাণ আন্দোলনে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী কী ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটা তিনি সবিস্তারে নিজের ওয়েবসাইটে টাঙিয়ে রেখেছেন। কেবল তাঁরা নন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আরও বহু নেতাই এর মধ্যে জড়িত ছিলেন। জে পি আন্দোলনের মধ্যেই তো বিজেপির জন্ম।
বিজেপি ও আরএসএস-এ যুগ্ম কুলতিলক নরেন্দ্র মোদীর তাই জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার অধিকার হতে পারত একশো শতাংশ। জরুরি অবস্থার ব্যঙ্গবিধুর সমালোচনা জরুরি হতে পারত। ‘হতে পারত’, যদি না মোদী তাঁর গত ছয় বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে ইতিমধ্যেই ইন্দিরা গাঁধীকে বহুলাংশে ছাপিয়ে গিয়ে না থাকতেন। না, এই ছয় বছরকে জরুরি অবস্থা বলা চলে না, খাতায় কলমে জরুরি অবস্থা এই দেশে আর হবেও না হয়তো। মাঝখানের পঁয়তাল্লিশ বছর একটা জিনিস শিখিয়ে গিয়েছে। কোনও আকস্মিক পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে না থামিয়েও, গণতন্ত্রের ভেতরে থেকেই গণতন্ত্রকে দিব্যি স্তব্ধ করে দেওয়া যায়— বর্তমান পৃথিবীতে অনেক দেশেই শাসক নেতারা শিখে নিয়েছেন সেই কৌশল। ভারতেও। শিখে নিয়েছেন কী ভাবে প্রতিবাদের ফুলকি দেখলেই তা পায়ে মাড়িয়ে নিবিয়ে ফেলতে হয়। সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও বুঝিয়ে দিতে হয়, প্রতিবাদ জিনিসটা মারাত্মক, ওর মানে রাষ্ট্রবিরোধী ফন্দিফিকির, পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র, চিনা আগ্রাসন। সরকারবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে আজ লোকসভা-রাজ্যসভা জুড়ে একচ্ছত্র হয়েছেন বলেই হয়তো সরকারবিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ বলে জনমানসে প্রতিষ্ঠার এই অসামান্য তাড়া তাঁদের।
সুতরাং আজ আর ‘প্রধানমন্ত্রীকে গদি থেকে নামাতে হবে’, ‘সরকার অচল করে দিতে হবে’, এই সব দাবি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না সরকারকে। রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য আইনবিধির ১২৪-এ ধারা এবং ইউএপিএ ধারায় প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করা কিংবা গ্রেফতারের পর জামিনের আপিল বরবাদ করার জন্য ছোটখাটো অপরাধ বা অভিযোগই যথেষ্ট। আনন্দ তেলতুম্বডে আর গৌতম নওলাখা ১৪ এপ্রিল ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আবার গ্রেফতার হন এনআইএ-র হাতে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে, মহারাষ্ট্র সরকারের সম্পূর্ণ মদতে, যদিও এখনও পর্যন্ত দলিত-আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করা ছাড়া আর কোনও ‘অপরাধ’ তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত নয়। ২০ এপ্রিল মাসরাত জাহরা নামে কাশ্মীরি চিত্রসাংবাদিক গ্রেফতার হন সরকারের সমালোচনার দায়ে। একই দিনে দিল্লি পুলিশ জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির সাফুরা জারগার আর মিরান হায়দরকে গ্রেফতার করে উত্তরপূর্ব দিল্লি দাঙ্গায় ‘উশকানি’ দেওয়ার অভিযোগে। ২৬ এপ্রিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েক জন গ্রেফতার হন একই অভিযোগে। এঁদের প্রত্যেকের বিষয়ে যে অভিযোগ, তাতে স্পষ্ট যে এঁরা চূড়ান্ত সরকার-বিরোধী। সিএএ প্রবর্তনকে এঁরা সংখ্যালঘুবিরোধী রাজনীতির উলঙ্গ প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। তাঁদের এই ধারণা ভুল কি ঠিক, সে বিষয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু এর ভিত্তিতে ইউএপিএ-র মতো চরম দমনমূলক ধারায় তাঁদের গ্রেফতার করে সমস্ত সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করাটাই আসল লক্ষণীয়। উত্তরপ্রদেশের ডাক্তার কাফিল খান জেলেই ছিলেন, এমতাবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে ওই জাতীয় নিরাপত্তা আইনেই মামলা ঠোকা হল, যাতে আর বার হতে না পারেন। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএএ-বিরোধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, এই তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা ধ্বংসের নমুনা। ইতিমধ্যেই বহু অধ্যাপক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, গবেষক, প্রশাসনিক কর্মী নাগরিক কোভিড-১৯’ সঙ্কটের অবকাশে সরকারি দমননীতির বাড়াবাড়ি নিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন সংবাদমাধ্যমে।
কেবল ইউএপিএ বা এনআইএ নয়। অন্যান্য ধারা প্রয়োগেও প্রতিবাদীদের হাজতবাস করানোর আকুলতা অনেকটা বেড়েছে। আমরা আপাতত বেঁচে থাকতে ব্যতিব্যস্ত, সুতরাং লক্ষও করছি না, সিএএ-বিরোধীদের কী ভাবে ঢোকানো হচ্ছে ‘অন্দরে’। দিল্লি থেকে আলিগড়, সমাজকর্মীরা ত্রাণ বিলি করতে করতে অকস্মাৎ গ্রেফতার হচ্ছেন।
সিএএ-বিরোধিতার মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিরোধিতা নেই, আছে একটি আইনের বিরোধিতা, সংবিধানের পক্ষে সওয়াল। কিন্তু এত শত কথার দরকারই বা কী। কোভিড-যুগে নেহাত মোদীর সমালোচনা করলেই জেলে পোরা যায়। দিল্লির ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিস্ট গ্রুপ’ (আরআরএজি) রিপোর্ট তৈরি করেছে: এ যাবৎ ৫৫ জন ভারতীয় সাংবাদিক জেলে গিয়েছেন এই কারণে। লকডাউন-পর্বে অশ্বিনী সাইনি বা ওম শর্মারা হিমাচল প্রদেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা আর বেপাত্তা রেশন-সামগ্রী নিয়ে ‘খবর’ করেছিলেন, তাই তাঁরা এখন জেলে।
গত শনিবার, ২৫ জুনের দুর্দান্ত সেই বার্তার ঠিক দুই দিন পর, ঐতিহ্যবাহী সংবাদ প্রতিষ্ঠান পিটিআই-কে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে প্রসার ভারতী। কারণ? তারা এক কূটনীতিকের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল চিন-ভারত সীমান্ত নিয়ে, যার তথ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যের কোনও মিল নেই! মোদীর কথার সত্য-মিথ্যা নিয়ে এমনিতেই দেশে প্রশ্নবন্যা, তার মধ্যে পিটিআই-এর প্রতিস্পর্ধা? নেমে এল খাঁড়া।
দেখেশুনে মনে পড়ছে অন্য এক দেশের কথা। বেজিং-এ এপ্রিল মাসে গ্রেফতার হয়েছেন এক দল ‘ভলান্টিয়ার’ বা সমাজকর্মী। সরকারি সেন্সর সে দেশের গত কয়েক মাসের করোনাভাইরাস ডিজিটাল তথ্য ‘ডিলিট’ করে দিচ্ছে, সেটা আটকাতে তাঁরা নিজেদের সফটওয়্যার নিয়ে নেমেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ‘পিকিং কোয়ারেলস অ্যান্ড প্রোভোকিং ট্রাবলস’, যে আইন দেখিয়ে চিন সরকার নিয়মিত ভাবে বিপজ্জনক লোকদের ‘তুলে’ নেয়। এবং তাদের আর পাওয়া যায় না। গণতন্ত্র নেই সে দেশে, সুতরাং খোঁজা-না খোঁজার খেলাটা খুবই সহজ। গণতান্ত্রিক দেশ হলে আইনটা আর একটু ‘কঠিন’ হতে হয়, নয়তো আবার সংবিধান নামক হ্যাপার কারণে জামিন-টামিনের গেরো ঢুকে পড়ে।
রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতাকে জব্দ করার নানা খেলা। কোন খেলা যে খেলবে কখন, এক এক রাষ্ট্রের এক এক সরকার তা এক এক ভাবে হিসেব করে। নিয়তির পরিহাস, এই মুহূর্তে আমাদের দেশের হিসেবটা হল, এক দিকে চিনকে বয়কট, অন্য দিকে চৈনিক স্বদেশী— যেখানে ‘পিকিং কোয়ারেলস অ্যান্ড প্রোভোকিং ট্রাবলস’ মানেই ‘সিডিশন’, সরকারের বিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা।