ছবি: পিটিআই।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হইয়াছে, এতটা বলিলে অত্যুক্তি হইবে। কিন্তু, নির্মলা সীতারামন বুঝাইয়া দিলেন, কেন্দ্র মচকাইতে রাজি। জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্যগুলির প্রাপ্য টাকার একটি অংশ— এক লক্ষ দশ হাজার কোটি টাকা— কেন্দ্রই ধার করিয়া রাজ্যগুলিকে দিবে বলিয়া জানাইয়াছেন অর্থমন্ত্রী সীতারামন। কেন্দ্রের গলায় হঠাৎ সমঝোতার সুর কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে দুইটি আপাত-ব্যাখ্যা মিলিবে। এক, প্রতিটি রাজ্য আলাদা ভাবে ঋণ করিবে, এমন ব্যবস্থায় আপত্তি জানাইয়াছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের মতে, কেন্দ্র ঋণ করিয়া রাজ্যগুলিকে দিলেই ভাল। দুই, কেন্দ্র নিজের অবস্থান নমনীয় না করিলে রাজ্যগুলি আদালতে যাইবার হুমকি দিয়াছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের মতে, প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন, তাঁহাদের গা-জোয়ারি আদালতে টিকিত না। ফলে, তাহার পূর্বেই পরিস্থিতি সামলাইতে তাঁহারা এক কদম পিছাইতে মনস্থ করিয়াছেন।
দুইটি কারণই সত্য, কিন্তু শুধু এই দুইটি কারণেই কেন্দ্র সুর নরম করিল, বলিলে গণতন্ত্রের শক্তিটিকে অগ্রাহ্য করা হয়। ইহা ঘটনা যে, জিএসটি কাউন্সিলে বিজেপির সংখ্যার জোর আছে। সেই জোরেই যে কোনও সিদ্ধান্ত পাশ করাইয়া লওয়া সম্ভব। তাহার পরও অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় ছিল। রাজ্যগুলির উপর যে কেন্দ্র ঋণের বোঝা চাপাইয়া দিতে পারে না, এই কথাটি হইতে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ডের ন্যায় রাজ্য এক বারের জন্যও সরিয়া আসে নাই। আপাতত আংশিক ভাবে হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী রাজ্যগুলির দাবি মানিতে বাধ্য হইতেছে। ইহাই গণতন্ত্রের জোর। নিজেদের এই সাফল্য হইতেই বিরোধী দলগুলি শিখিতে পারে, সংখ্যার শক্তি না থাকিলেও কী ভাবে গণতান্ত্রিক পরিসরগুলিকে ব্যবহার করা যায়, কী ভাবে শাসকের উপর নিরন্তর চাপ বজায় রাখা যায়। বস্তুত, সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করিতে পারাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ারই অঙ্গ। কিছু দিন পূর্বে রাহুল গাঁধী প্রশ্ন করিয়াছিলেন, সরকার যদি যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিয়া রাখে, তবে বিরোধীরা কাজ করিবেন কী ভাবে? তাঁহার এই প্রশ্নের একটি উত্তর জিএসটি কাউন্সিলের পরিসরে মিলিয়াছে। ঘটনা হইল, কেন্দ্রীয় সরকার সমানেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পঙ্গু করিতে চাহিতেছে। কিন্তু সেই প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়াইয়া কী ভাবে পরিসরগুলির উপর নিজেদের দাবি পুনর্বহাল করা যায়, সেই পথ সন্ধান করাও বিরোধী রাজনীতির কর্তব্য। জিএসটি কাউন্সিল দেখাইয়া দিল, তাহা খুব রকম সম্ভব।
লড়াই অবশ্য শেষ হয় নাই। কার্যত সব বিরোধী রাজ্যই জানাইয়াছে, অর্থমন্ত্রীর এই সমঝোতাসূত্রটিও গ্রহণযোগ্য নহে— ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্যের গোটা টাকাই কেন্দ্রীয় সরকারকে ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে। এক্ষণে লক্ষণীয়, দরকষাকষিতে ক্ষমতার পাল্লাটি আপাতত রাজ্যগুলির দিকে ঝুঁকিয়া আছে। প্রথমত, ১.১ লক্ষ কোটি টাকার ব্যবস্থা করিতে সম্মত হইয়া কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষতিপূরণের টাকা জোগাড় করিয়া দিবার নৈতিক দায়টি মানিয়া লইয়াছে। অর্থাৎ, এত দিন যাবৎ অর্থমন্ত্রী হাত ঝাড়িয়া ফেলার যে চেষ্টা করিতেছিলেন, রণকৌশল হিসাবে তাহা বাতিল হইয়া গেল। দ্বিতীয়ত, অতিমারি ও আর্থিক লকডাউনের ফলে রাজ্যগুলির যখন নাভিশ্বাস উঠিতেছে, তখন জিএসটির টাকা আটকাইয়া রাখা রাজনৈতিক ভাবেও সুবিবেচনার পরিচয় হইতেছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সেই চাপটিও অস্বীকার করা অসম্ভব। এই মুহূর্তে বিরোধী নেতারা রাজনৈতিক পরিসরটিকে কী ভাবে ব্যবহার করিতে পারেন, তাহা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভবিষ্যতের পক্ষে অতি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লইবে।