সুপ্রাচীন গ্রিক নাট্যের বার্তা কি মোদী পড়েছেন?

বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেতার অর্থ এই নয় যে পরবর্তী পাঁচ বছর প্রতিটি পদক্ষেপের আগাম অনুমোদন সরকার লাভ করেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালআমরা ভারতের এই বিপুল জনসমাজ কি সিসিফাসের প্রেতাত্মা? আমরাও জানি এ পাথর পড়ে যাবে। যখন ঠেলে ঠেলে তুলছি তখনই জানি, এ ঠেলার কোনও মানে নেই। পাহাড়ের ওই চুড়োর কোনও মানে নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৬ ০১:০৩
Share:

বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি মনে আছে? সেখানে ইন্দ্রজিৎ বলছেন, দেবরাজ জুপিটারের অভিশাপে প্রেতাত্মা প্রকাণ্ড ভারী পাথরের চাঁই ঠেলে পাহাড়ের চুড়োয় তোলে। যেই চুড়োয় পৌঁছয় আবার গড়িয়ে নীচে পড়ে যায় পাথরটা। আবার ঠেলে ঠেলে তোলে। আবার পড়ে যায়, আবার তোলে।

Advertisement

আমরা ভারতের এই বিপুল জনসমাজ কি সিসিফাসের প্রেতাত্মা? আমরাও জানি এ পাথর পড়ে যাবে। যখন ঠেলে ঠেলে তুলছি তখনই জানি, এ ঠেলার কোনও মানে নেই। পাহাড়ের ওই চুড়োর কোনও মানে নেই।

লেখক লিখতে পারছেন না, কারণ তাঁর কাছে জীবনের কাহিনি নেই। ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রজিৎ হতে পারছেন না। কারণ, ইন্দ্রজিৎ অমল, বিমল, কমল হতে পারলেও ইন্দ্রজিৎ হতে পারছেন না।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর দু’বছরের মাথায় মনে হচ্ছে সেই একই রূপক। যত বার আলো জ্বালাতে চাইছেন নিভে যাচ্ছে বারে বারে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের পেনশন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে দোষ নেই। বরং গণতন্ত্রে এই এককদম এগিয়ে দু’কদম পিছোনই দস্তুর। সেটাই তো গণতন্ত্র। রাজীব গাঁধীকেও প্রেস বিল প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। সমস্যা বরং বাড়ে যদি শাসক দল একগুঁয়ে হয়। অনমনীয় শাসক দল মনে করে, যা করছি বেশ করছি।

গত দু’বছর ধরে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের কাজকর্মে সেই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছিলেন, রাজা সাধারণ মানুষের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনটা তাঁর ভাল লাগছে সেটা নয়। প্রজারা কোনটাকে ভাল সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে সেটাই হবে রাজার সিদ্ধান্ত। মোদী সরকার যখন নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রধান নিয়োগ করার কথাই হোক আর মন্ত্রিসভায় এফডিআই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হোক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের যেমন একচেটিয়া অধিকার রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের, তেমন ভাবে সেই সিদ্ধান্ত আমজনতা গ্রহণ করছে কি না সেটাও দেখা প্রয়োজন। সরকার যখন ভোটে জেতে তখন মানুষের ভোটেই জেতে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেতার অর্থ এই নয় যে পরবর্তী পাঁচ বছর প্রতিটি পদক্ষেপের আগাম অনুমোদন সরকার লাভ করেছে। ভারতীয় সংবিধানের স্পষ্ট নির্দেশ, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে। সেই অনুমোদন না থাকলে জিএসটি পাস করা যায় না, জমি বিল পাস করা যায় না। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য। আন্তিগোনে নাটকে রাজা ক্রেয়ন-এর সঙ্গে তাঁর পুত্রের কথাবার্তা হচ্ছে। পুত্রকে বাবা বলছেন, আমি রাজা। আমি তো অনুশাসন দেব। আমি যা বলব তাই বিধি। সেই সার্বভৌম। তা মানাতেই মানুষের কল্যাণ। ছেলে বাবাকে বলছেন, কিন্তু বাবা, তোমার রাজকীয় অনুশাসন কার জন্য? সাধারণ মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্যই তো? আমজনতার স্বার্থই শেষ কথা। আর যদি মানুষকেই অবজ্ঞা করা হয় তা হলে তুমি কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপে গিয়ে দেশ শাসন কর। সেখানে বসে অনুশাসন জারি করো। কী সাংঘাতিক বার্তা সুপ্রাচীন গ্রীক নাট্যে। আজ নরেন্দ্র মোদীকেও সেই কথাটাই মনে রাখতে হবে। প্লেটো ভেবেছিলেন, রাষ্ট্র মানে সরকার ও নাগরিক সমাজ ও চার্চ। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র। কিন্তু অ্যারিস্টটল গুরুর বক্তব্য খণ্ডন করে বলেছিলেন, রাষ্ট্র মানেই সরকার ও নাগরিক সমাজ নয়। সরকার ও নাগরিক সমাজে এ সবের পৃথক আকারগত অবস্থিতি আছে। ভিন্নতা আছে।

সেই ভিন্নতার মধ্যেই আজকের বহুত্ববাদের শিকড়। শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠন করতে গিয়ে নাগরিক সমাজকেও নিয়ন্ত্রণে আনার রাষ্ট্রীয় চেষ্টা অনভিপ্রেত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement