প্রতীকী চিত্র।
স্বাধীনতার আগে ও পরের বেশ কয়েক দশক ধরে শিক্ষকদের অবস্থা ছিল এক রকম। গত কয়েক দশকে শিক্ষকদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণভাবে আমাদের চিন্তাধারার কি পরিবর্তন হয়েছে?
কয়েক দশক আগে শহরকেন্দ্রিক শিক্ষার সঙ্গে গ্রামের টোল পাঠশালার মধ্যে ছিল ‘বিচ্ছেদের ছুরি’ (শিক্ষার বিকিরণ) শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের খুব কম অংশ বরাদ্দ করার কারণে প্রায় স্কুলগুলিতে দেখা যেত দৈন্য। আর শিক্ষকদের বেতন ছিল অতি সামান্য। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ তারাশঙ্করের ‘সন্দীপন পাঠশালা’ উপন্যাসটি। সেখানে দেখি মহেশপুর পাঠশালার এক পণ্ডিতমশাই শিক্ষাখাতে সাহায্য বাড়ানোর প্রার্থনা করছেন- “বৃদ্ধ পণ্ডিত বললে, বাবুমশায়, আজ পঁয়ত্রিশ বৎসর পাঠাশালা করছি, প্রথম ছিল দু’টাকা সাহায্য। কিন্তু আজও পাঁচ টাকা হল না।”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুবর্তন’ স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকতার জীবন্ত দলিল। কলকাতার ‘ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুল’টিতে সাহেব ও দু’একজন ছাড়া বাকি শিক্ষকদের জীবন দৈন্যপীড়িত। ১৮৬৫ সালের ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রে বলা হয়েছিল- “এ দেশীয় মুন্সেফদিগের ন্যায় এ দেশীয় শিক্ষকেরা পর্যাপ্ত বেতন পান না। অথচ তাঁহাদিগের খাটুনি ও পরিশ্রমের ত্রুটি নাই।” প্রায় নব্বই বছর পরে প্রকাশিত হচ্ছে মনোজ বসুর ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে স্কুলটিচার বলে মহিমারঞ্জনের বিয়ে ভেঙে যায়। মহিম মাষ্টারি করে শুনে ম্যাকলিন কোম্পানির বড়বাবুর মেয়ের তার সঙ্গে বিয়ে হয় না। এখন তাদের বেতন বেড়েছে, তাই খবরের কাগজে ‘মাস্টার –অধ্যাপক চলিবে’ এই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছে।
রাধাকৃষ্ণন কমিশনের (১৯৪৮-৪৯) সময় বের হচ্ছে জীবনানন্দের উপন্যাস ‘জলপাইহাটি’, যেখানে অধ্যাপক নিশীথ সেনের মাইনেও জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট কম। নিশীথ ভাবছেন- “দেশের ভিতর মাস্টারির চিতা জ্বলছে আজ দিকে দিকে। মাস্টারদের কোনো বন্ধু নেই আজ। ...একজন বাবুর্চি বা মোটর ড্রাইভার যে টাকা পায়, ইউনিভারসিটির একজন লেকচারার... তার চেয়ে কম পায়।” উপন্যাসে হারীত আর সুলেখাকে জানায়- “তার নীচে তো মুচি, মুদ্দোফরাস, কামার, চামার, জোলা, তাঁতী, ধোপা, নাপিত, জেলে, চাষাভুষো। এদের অনেকে মাস্টারদের চেয়ে বেশি কামায়...”। ১৯৪৮ সালে ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘শিক্ষা দীক্ষা শিক্ষকতা’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ ক্ষোভ আর দুঃখের সঙ্গে লিখছেন-“ ঘর নেই, চাল নেই কাপড়ের পেছনের দিক ছিঁড়ে গেছে মাস্টারদের; তাদের স্ত্রীদের, এরা বেসরকারিজীবী বলেই এদের জন্য কোনো কমিশন নেই-এরকম হতভাগা দেশে কোনো স্কুল কলেজ না থাকাই ভালো। সব পুলিশ হয়ে যাক, সেপাই হয়ে যাক।” আর একই হতাশা নিয়ে ‘সন্দীপন পাঠশালা’র ভূমিকায় তারাশঙ্কর বেদনাজারিত কণ্ঠে বলেছেন-“বাংলাদেশের শিক্ষক-জীবন অবহেলিত, অনাদৃত। পাঠশালার শিক্ষক বা পণ্ডিতমশায়দের তো কথাই নাই। এঁদের সুখদুঃখ অবহেলিত, সমাজজীবনে সামান্যতম সম্মান থেকেও এঁরা বঞ্চিত।” এই রকম বঞ্চনার কথা আছে তারাশঙ্করের’ পণ্ডিত মশায়’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “টিচার’ গল্পে।
মনোজ বসুর ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ উপন্যাসে মহিমারঞ্জন মাস্টারি নিয়েছে শুনে সাতু ঘোষ বলেছে- “ইস্কুল মাস্টারি হল তোমার কাজ-মানুষ গড়ার মহাব্রত! বারো বছর যে কাজ করলে গাধা হয়ে যায়। তোমার অতদিন লাগবে না, এখনই আদ্দেক হয়ে আছে। নইলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে কেউ এমন!” স্বাধীনতার আগে ও পরে এই ছিল শিক্ষকতা সম্পর্কে আম আদমির ধারণা।
শিক্ষক একই সঙ্গে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীচরিত্রের একটি ছাঁদ বা আদল বয়ে নিয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের মনে থেকে গিয়েছে সন্দীপন মুনি হোক বা বুনো রামনাথই হোক এঁরা শত কষ্ট সহ্য করেও আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। সমাজে অধিকাংশ মানুষের মনে চিরন্তন শাশ্বত একটি প্রতিমা মুদ্রিত হয়ে আছে, যে জীর্ণ মলিন ধুতি ফতুয়া বা পাঞ্জাবি পরা, হাতে লম্বা বাঁটের শতছিদ্রসমন্বিত ছাতা, যেটা থেকে মাঝে মাঝে বের হয় দু’দশটা আরশোলার ছানা আর পেটে অনেকটা খিদে, তবু মুখেচোখে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অনন্ত ভালোবাসা আশা ভরসা। এই কয়েক দশক আগেও এই চিত্রই আমরা আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনে দেখেছি। এটার বিপরীত হলেই আমরা রে রে করে তেড়ে আসি। আমরা ভুলে যাই ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ শিক্ষকদেরও পরিবার পরিজন আছে, তারাও রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের খিদে আছে তেষ্টা আছে- তাঁরা কোনও মসীহা বা ভিন গ্রহের জীব নন। শিক্ষকদের মাইনে বা সুযোগ সুবিধে একটু বাড়লেই সমাজের নানা মহল থেকেই পরশ্রীকাতর মন্তব্য শোনা যায়।
১৯৪৭ সালের গল্প ‘টিচার’ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখান শিক্ষকরা মাইনে বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করবে শুনে স্কুলের সেক্রেটারি অবিনাশ তরফদার বলে- “বিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা কি মজুর না ধাঙড় যে ধর্মঘট করবে?” এই মানসিকতা থেকে কি আমরা এখনও মুক্ত হতে পেরেছি? তাই এখনও শিক্ষকদের ঘরে-বাইরে নানাভাবে লাঞ্ছনা জুটছে।
অন্যদিকে আজ শিক্ষকতা কেবলমাত্র একটি জীবিকা হয়ে উঠেছে, আর পাঁচটা চাকরির মতোই এর নিয়মকানুন। পড়া ও পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রান্নাবান্না, আদমশুমারি, নির্বাচনসহ আরও নানারকম কাজকর্ম। আগেও শিক্ষকদের নানা উপজীবিকা ছিল যেমন টিউশন বইয়ের ক্যানভাসিং, মুদিখানার দোকান চালানো, চাষবাস, পুজো-আচ্চা। অপ্রিয় হলেও সত্যি, এখনও অনেক শিক্ষকদের দেখি, যাঁরা কোচিং সেন্টারে পড়ান, টিউশন করেন, নোটবই লেখেন, জীবনবীমার পলিসি বিক্রি করেন এমনকি জায়গা-জমির দালালিও করেন। কেউ কেউ আবার সেমিনারে একই কুমিরছানাকে সাতবার দেখানোর মতো একই বিষয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন। বিশ শতকের শিক্ষা –শিক্ষকতার হালহকিকত বুঝতে হলে আর. কে. নারায়ণের ‘দি ইংলিশ টিচার’, বিমল মিত্রের ‘রাজাবদল’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তেঁতুল পাতার ঝোল’ বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘জলছবি’ উপন্যাস পড়তে হবে। কখনও আমরা শিক্ষকদের নানা অধঃপতনের খবর শুনি- আমরা হতাশ নই, তবু এরই মাঝে আমরা প্রকৃত ছাত্রদরদী নীতিবান আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষকদের দেখি, যাঁরা আছেন বলে আজও বাংলার শতশত ছাত্রছাত্রী তৈরি হচ্ছে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে, সারস্বত সাধনার পথিক প্রকৃতই মানুষ গড়ার কারিগর তাঁরা।
গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর রবীন্দ্রনাথের আস্থা ছিল না। তিনি দেখেছিলেন এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু পরীক্ষা পাশের একটি নিয়ম-শাসিত পন্থা-যা জাতির চৈতন্যকে নাড়া দিতে পারে না। সেই নিয়মের কারাগারে নিয়ত রচিত হবে নিত্য নতুন ‘তোতা কাহিনী’ গড়ে উঠবে একটি করে ‘অচলায়তন’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষা’ গ্রন্থের ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে প্রচলিত শিক্ষাকে বলেছেন- ‘মানসিক শক্তিহ্রাসকারী নিরানন্দ শিক্ষা’-যাতে ছাত্রদের ‘পৃষ্ঠের মেরুদণ্ড বাঁকিয়া যায় এবং মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীন বিকাশ হয় না।’ তাই তিনি চেয়েছেন ‘শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য সাধন’।
তাই রবীন্দ্রনাথ বলেন- “বর্তমানকালে আমাদের দেশের শিক্ষায় সেই গুরুর জীবনই সকলের চেয়ে অত্যাবশ্যক হইয়াছে।...আমাদের সমাজ-ব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের জীবনকে গতিদান করিবেন; আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সেই গুরুকে খুঁজিতেছি যিনি আমাদের চিত্তের গতিপথকে বাধা মুক্ত করিবেন।” (শিক্ষাবিধি) সেই গুরুর সান্নিধ্যে এলে আমাদের মনের সকল কালিমা দূর হয়ে যাবে। আমাদের ছাত্রজীবনেও এই রকম মাস্টার মশাইদের পেয়েছি, ভবতোষ দত্ত, ভূদেব চৌধুরী, সুখময় মুখোপাধ্যায়, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, গোপিকানাথ রায়চৌধুরী, পশুপতি শাশমল, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যূথিকা বসু, আলপনা রায়চৌধুরী, সুতপা ভট্টাচার্য, অলিভা দাক্ষী, অনঙ্গমোহন রুদ্র, অমল পাল, স্বপন বসু, মিহির চৌধুরী কামিল্যা, সুমিতা চক্রবর্তী, কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী, আশিস কুমার দে, শিবব্রত চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চক্রবর্তী প্রমুখ। তাঁদের ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না, তাঁদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম। আপনারা আমাদের আত্মার সঙ্গেই আছেন, ভালো থাকবেন মাস্টার মশাই।
লেখক পূর্ণিদেবী চৌধুরী গার্লস কলেজের বাংলার শিক্ষক