প্রতীকী চিত্র। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
শারীরিক হেনস্থা, সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি এবং সর্বোপরি হত্যা, প্রতিটি অপরাধের জন্যই যখন ভারতীয় দণ্ডবিধিতে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তখন ‘লিঞ্চিং’ বা গণনিধন নিবারণে পৃথক আইনের প্রয়োজন হয় কেন? তাহার একমাত্র কারণ, গণনিধন কোনও সাধারণ অপরাধ নহে, তাহা ব্যক্তির পরিচিতির কারণে, সেই পরিচিতির বিরুদ্ধে, সংগঠিত অপরাধ। গত কয়েক বৎসরে ভারতে গণনিধনের যত ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার তালিকাটি দেখিলেই স্পষ্ট হইবে, নিহত বা আক্রান্তদের পরিচিতিটি গুরুত্বপূর্ণ— গোহত্যার অজুহাতে যাঁহাদের আক্রমণ করা হইয়াছে, তাঁহাদের অধিকাংশই মুসলমান, কিছু ক্ষেত্রে দলিত। ছেলেধরা সন্দেহে যাঁহাদের পিটাইয়া খুন করা হইয়া থাকে, তাঁহারাও প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে গরিব, প্রান্তিক মানুষ। যাহারা আক্রমণ করে, তাহাদের উদ্দেশ্য যে ব্যক্তিবিশেষকে হেনস্থা করা, খুন করা, শুধু সেইটুকু দাবি করিবার উপায় নাই— এই আক্রমণগুলি স্পষ্টতই কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বার্তা দিবার উদ্দেশ্যে হয়। অর্থাৎ, গণনিধন প্রকৃত প্রস্তাবে পরিচিতির— সংখ্যালঘু পরিচিতির— বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ। অতএব, তাহার জন্য পৃথক আইন করিবার যুক্তি আছে।
আরও উদ্বেগের বিষয়, গোহত্যা ইত্যাদির অজুহাতে গণনিধনের প্রবণতা কমিবার লক্ষণমাত্র নাই। সম্প্রতি রাজস্থান হাইকোর্টে গোরক্ষকদের হাতে নিহত পেহলু খানের বিরুদ্ধে গরু চোরাচালানের মামলা খারিজ হইয়া গেল। যদি সত্যই পেহলু চোরাচালান করিতেন, তবুও তাঁহাকে গণপ্রহারে খুন করিবার ঘটনাটি ন্যায্য, আইনসঙ্গত হইত না। যে রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ, সেখানে কেহ সেই কাজটি করিলে বা তাহাতে সাহায্য করিলে তাহা অপরাধ। কিন্তু, সেই অপরাধের বিচার করিবার ভার উন্মত্ত জনতার হাতে নাই। দেশে পুলিশ রহিয়াছে, আদালত রহিয়াছে। অপরাধীর বিচার সেখানে হওয়াই বিধেয়। অন্যায় ভাবে যাঁহাকে খুন করা হইয়াছে, তাঁহার বিরুদ্ধে গরু চোরাচালানের মামলা দায়ের করিবার মধ্যে যে প্রবণতাটি আছে, তাহা ভয়ঙ্কর— ইহা দ্ব্যর্থহীন ভাবে গোসন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া। তাহাদের জানাইয়া দেওয়া যে রাষ্ট্রশক্তি তাহাদের পিছনেই আছে। বস্তুত, মহম্মদ আখলাকের হত্যা হইতে আজ অবধি দেশের শাসকরা গোসন্ত্রাস লইয়া যাহা বলিয়াছেন এবং বিশেষত যাহা বলেন নাই, সব মিলাইলে বোঝা যায় রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন কাহাদের প্রতি। এই অবস্থায় গণনিধনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়। সেই কঠোরতার জন্য প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করিবার প্রয়োজন কি না, সেই তর্ক চলিতেই পারে। কিন্তু, তাহার জন্য এই আইনটিকে স্থগিত রাখা কি উচিত কাজ?
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় বিধানসভায় পাশ হইয়া আসা বিলটিতে স্বাক্ষর করেন নাই। বিলটির বয়ান দুই রকম কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হন নাই। স্বীকার করিতেই হইবে, তিনি তাঁহার সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারের গণ্ডির মধ্যে থাকিয়াই কাজটি করিয়াছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনিই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, কাজেই বিলে স্বাক্ষর না করিবার অধিকার তাঁহার আছে। এক্ষণে প্রশ্ন, কাজটি করিবার অধিকার আছে বলিয়াই কি তাহা করা উচিত? বিশেষত এই রকম ক্ষেত্রে, যেখানে আইনটি তৈরি হইয়া গেলে বহু দুর্বৃত্ত হয়তো খানিক সংযত হইত, হয়তো কয়েক জন পেহলু খান প্রাণে বাঁচিয়া যাইতেন। এবং, আরও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, তাঁহার এই কালক্ষেপের সিদ্ধান্তটিকে কেহ তাঁহার পক্ষপাত হিসাবেই দেখিতে পারে। এই আইন পাশ হইলে মূলত কাহারা আইনটির কোপে পড়িবে, অনুমান করা চলে। দুর্জনে বলিবে, রাজ্যপাল তাহাদের বাঁচাইতে অতিসক্রিয় হইলেন। রাজ্যপালের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির গায়ে এই কালিমা লেপনের প্রয়োজন ছিল কি না, শ্রীধনখড় ভাবিয়া দেখিতে পারেন।