এনকাউন্টারের স্থলে তেলেঙ্গনা পুলিশ
যাক, সব চুকেবুকে গিয়েছে। নতুন ভারতে কোনও কাজ আর পড়ে থাকছে না। চার-চারটে ‘রেপিস্ট’ এক নিমেষে নিকেশ হয়ে গেল। মামলা সাজাও রে, আদালতে তারিখ পে তারিখ পড়ুক রে, বছরের পর বছর শুনানি চলুক রে, নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে মামলা পৌঁছক রে, এত সবের কোনও দরকারই রইল না আর। জনতা জনার্দন ফাঁসি দাও, পুড়িয়ে দাও, থেঁতলে মারো বলে চেঁচাচ্ছিল। নামী-দামি সাংসদেরা তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলেন। তেলঙ্গানা পুলিশ করে দেখিয়ে দিল। আহা! ৬ ডিসেম্বরের সকালে যেন রামরাজ্যের আমেজ!
এমন উলুধ্বনির মুহূর্তে যাঁরা বেসুরো প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা নিশ্চয় দেশদ্রোহী! ও সব শৌখিন ‘মানবাধিকারওয়ালা’দের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করাই ভাল! যারা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়, তাদের আবার মানবাধিকার কিসের? কথাটা আলগা ভাবে শুনতে চটকদার। কিন্তু তার মধ্যে মস্ত একটা ফাঁদ আছে। এই কথাটা যেন আগে থেকেই ধরে নিয়েছে, মানবাধিকারের প্রশ্নটা শুধু অভিযুক্তদের নিয়ে। মানবাধিকারের কথা তোলা মানে যেন শুধু অভিযুক্তদের রক্ষাকবচ সন্ধান করা। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার মতো কাজ যারা করে, তারা তাদের মানবাধিকারের দাবি খুইয়েছে। কিন্তু যারা তাদের মারল? তারা তো মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য নিযুক্ত হয়নি। তারা তো আইন রক্ষারই শপথ নিয়েছে! সেই শপথ ভঙ্গের দায় তাদের উপরে বর্তাবে না? চার্জশিট হল না, দোষ প্রমাণ হল না, সাজা ঘোষণা হল না—বিচারপ্রক্রিয়াকে বেমালুম পাশ কাটিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠার অধিকার তো পুলিশের নেই। নেই যে, সেটা পুলিশও জানে বলেই এই ‘এনকাউন্টার’ শব্দটার প্রয়োগ। অর্থাৎ খাতায়কলমে দাবি করার ব্যবস্থা যে— আত্মরক্ষার তাগিদে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। এ বার পুলিশ হেফাজতে থাকা চারটে নিরস্ত্র যুবক যদি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করে থাকতে পারে এবং প্রাণ বাঁচাতে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়ে থাকে, সেটা পুলিশের সাফল্য? না কি পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা?
আপাতত জনতার নজর অবশ্য এ দিকে নেই। এমনকি বহুলাংশে আইনপ্রণেতাদেরও নেই। নইলে দল-মতের বেড়া ডিঙিয়ে সাংসদেরা পুলিশকে বাহবা দিতেন না। তাঁরা খেয়ালও করলেন না, এই ‘এনকাউন্টার’ যদি সত্যি ‘এনকাউন্টার’ই হয়ে থাকে, তা হলে সেটা পুলিশের পক্ষে কতখানি লজ্জার কথা। আর ‘এনকাউন্টার’ যদি সাজানো ঘটনা হয়ে থাকে, ভুয়ো সংঘর্ষ হয়ে থাকে, তা হলে সেটা কতখানি উদ্বেগের কথা। চারটে খুনি-রেপিস্টকে কোনও বিচারপ্রক্রিয়ায় না গিয়েই এক লপ্তে খতম করে দেওয়া গিয়েছে, এ ঘটনায় যখন দেশের আইনপ্রণেতারা উল্লসিত হন, তখন বুঝতে হবে, একটা সিস্টেম শুধু পচেই যায়নি, পচনটা সর্বোচ্চ স্তরে স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে। আপাদমস্তক সেই ব্যর্থতাকে আমরা এখন মেডেলের মতো গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছি। মনে করছি, পুলিশ একটা উচিত কাজ করেছে। দশ-বারো বছর মামলা চলবে, তার পর কবে কী শাস্তি হবে না হবে, তার চেয়ে এই ভাল।
এ দেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিসর্জন এমনিতেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আমরা তাতেও খুব বেশি হেলদোল দেখাইনি। এ বার বিচারপ্রক্রিয়াটাও বাতিলের খাতায় চলে গেল দেখে উদ্বাহু নৃত্য করছি। পুলিশকে দিয়ে অপরাধীকে খুন করানোর পদ্ধতিকে নতুন বৈধতায় অভিষিক্ত করছি। গণতন্ত্র ভাল চলছে না বলে ফ্যাসিবাদকে আলিঙ্গন করতে চায় যে মন, সেই মন এই রকমই শর্টকাট খোঁজে। আমরা সুস্থ সমাজ গড়তে পারিনি, কার্যকর প্রশাসন তৈরি করিনি, বিচারব্যবস্থাকে দ্রুত লয়ে বাঁধতে পারিনি। অগত্যা এখন ট্রিগার-অন্ত-প্রাণ পুলিশের কেরামতি দেখে হাততালি দিচ্ছি। যেন অবশেষে একটা মনের মতো ‘দি এন্ড’ হল! সিনেমায় যেমন হয়! সিম্বা-র রণবীর সিংহ, আ ওয়েনেসডে-র জিমি শেরগিল, অব তক ছপ্পন-এর নানা পটেকর, সিংহম-এর অজয় দেবগণ কিংবা নায়ক-এর অনিল কপূররা এত দিন তো এই কাহিনিই ফেরি করেছেন। কোনও কচকচির দরকার নেই, ঠোক দিয়া। নরকের কীটেরা নরকে চলে যাক!
এ বড় অদ্ভুত সময়। নেট খুললেই ধর্ষণ, খুন, লাইভ আত্মহত্যা; অঢেল সমাহার। চ্যানেল ঘোরালে রিয়েলিটি শো। বড় পর্দা থেকে ওয়েব সিরিজ়, ‘সত্য ঘটনা অবলম্বন’এর ভরা জোয়ার। বিনোদন যত রিয়েলিটিকে আঁকড়াচ্ছে, রিয়েলিটি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়ে উঠছে বিনোদনের মতো। সেখানে এখন নিত্যনতুন টুইস্ট চাই, ধামাকা চাই। সবচেয়ে বড় কথা, নায়ক চাই। অ্যাকশন হিরো চাই। অ্যাকশনের তুবড়ি কাকে বলে, সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত দেখিয়ে থাকেন। আজ সার্জিকাল স্ট্রাইক তো কাল বালাকোট, পরশু নোটবন্দি তো তরশু ৩৭০। সোশ্যাল মিডিয়া নামক চুল্লির আঁচ যেন পড়ে না যায়। মানুষ যেন প্রতিনিয়ত অনুভব করেন, একটা কিছু হচ্ছে! সরকার বসে নেই! তেলঙ্গানা দেখিয়ে দিল, তারা প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য ছাত্র— দেশে এখন সার্জিকাল স্ট্রাইক ছাড়া চিঁড়ে ভেজে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এক দিকে ন্যায়বিচারের অসহনীয় দীর্ঘসূত্রিতা আর অন্য দিকে একের পর এক পৈশাচিক অপরাধের সাক্ষী থাকতে থাকতে দেশবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা কি অস্বাভাবিক? দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, হতাশা আর অসহায়তা যদি এই এনকাউন্টারে কিছুটা কলজে জুড়োনো অনুভব পেয়ে থাকে, তা কি একেবারেই অপ্রত্যাশিত?
না, নিশ্চয়। কিন্তু যা কিছু দৃশ্যত ‘স্বাভাবিক’, তা-ই সমর্থনীয়, এমনও তো নয়। কারও দোষ প্রমাণ হওয়ার আগে, দোষ প্রমাণ হওয়ার সুযোগটুকুও না দিয়ে তাকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে মেরে ফেলাটাই যদি ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা হয়, তার চেয়ে বেদনাময় কিছু হতে পারে না। আর এ দেশের এনকাউন্টার-ইতিহাস মাথায় রাখলে তো পারেই না। বরং ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্তের এনকাউন্টারকে ঘিরে এই যে জনসমর্থনের বন্যা বইছে, তাতে রীতিমতো আশঙ্কা হয় যে, এর পর ধর্ষক-খুনি নাম দিয়ে অন্য অনেককেও না নিঃশব্দে সাফ করে দেওয়া হয়! এ দেশ সত্তরের দশক দেখেছে, ইশরাত জহান দেখেছে, আজাদ হত্যা দেখেছে, সোহরাবুদ্দিন মামলার পরিণতিও দেখেছে। নিহতেরা আলাদা হতে পারে, সব মরণ সমান না হতে পারে, কিন্তু আজ্ঞাবাহী পুলিশের মুখ আর কত আলাদা হবে?
পনেরো বছর পিছিয়ে যাই এক বার। ২০০৪ সালে ফাঁসি হল ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের। এ রাজ্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ফাঁসি চেয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। পনেরো বছরে ধর্ষণ কমেনি। শুধু বড় মাপের কোনও অপরাধ হলেই ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসিই চাই’ বলে গলা চড়াতে শিখে নিয়েছে ভারতবাসী। এ বার থেকে ‘এনকাউন্টার চাই’ বলে দাবি উঠবে। উঠছে। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র আর কী কী সম্ভাব্য রূপ হতে পারে, তা-ই নিয়ে গবেষণা হবে। হচ্ছে। ইতিউতি অনেকে বলছেন, গোপন নয়, প্রকাশ্য এনকাউন্টার দরকার! অনেকে বলছেন, পুলিশ কেন, জনতা আছে কী করতে! দল পাকিয়ে খুনখারাপি তো চালু হয়েই গিয়েছে! গরু খেলে খুন করা যায়, ধর্ষণ করলে পিটিয়ে মারা যাবে না?
এ দুর্ভাগা দেশ এখন আর বলে না, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন! সে বলে, ও যদি করে, আমি করব না কেন? এই ‘ও’ ক্ষেত্রবিশেষে পড়শি রাষ্ট্র হতে পারে, কোনও সম্প্রদায় হতে পারে, কোনও রাজনৈতিক প্রতিযোগী হতে পারে, যে কেউ হতে পারে। আমরা নিশ্চয় ক’দিন বাদে বলব, আইএস যদি মুন্ডু কাটার ভিডিয়ো বানাতে পারে, আমরা পারব না কেন?
পারিনি একদম, তা-ও নয়। ওই যে, আফরাজুলকে যেমন ক্যামেরার সামনে কুপিয়ে কেটে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল! সেই বীর সন্তান শম্ভুলাল রেগার জেলে কী খাচ্ছে, জানা যায় না অবশ্য! আমরা আপাতত উন্নাও-তে এনকাউন্টার হবে কি না, সেই জল্পনায় মশগুল। দু’দিন আগে তেলঙ্গানা ধর্ষণের ভিডিয়ো আছে কি না, খুঁজে দেখছিলাম। এখন এনকাউন্টারের ভিডিয়ো খুঁজব। আমরা ধর্ষক নই, দর্শক মাত্র। ‘জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও’ বলে হাঁকাহাঁকির বিরোধিতা করলে যারা পাল্টা ধর্ষণ করার নিদান দিচ্ছিল, তারা ক্রুদ্ধ জনগণ মাত্র। এনকাউন্টার নিয়ে প্রশ্ন তুললে যারা ট্রোল করছে, তারা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক মাত্র।
বহুব্যবহৃত বাক্যটাই মনে পড়ে আবার— যেমন নাগরিক, তার তেমনই শাসক। যেমন সমাজ, তার তেমনই নাগরিক।