এই জলসঙ্কট থেকে পরিত্রাণের উপায়, সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে রাজ্যে রাজ্যে, এলাকায় এলাকায় জল সংরক্ষণ কমিটি গড়ে তোলা। কৃত্রিম ছাদ তৈরি করে লম্বা পাইপের মাধ্যমে সে জল আন্ডারগ্রাউন্ডে পৌঁছে দেওয়াও বড় বড় জলাধারে বৃষ্টির জল ধরে রাখা, যা শুখা মরসুমে সেচের কাজে লাগে।
বলতে বলতে আমার সে গল্পের প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। মন্ত্রীর সেই ঘোষণার বছর দশেক বাদে দেখা দিল ভয়ঙ্কর জলসঙ্কট। চাষিরা পাম্প চালিয়ে ভূগর্ভ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল তুলতে লাগল। কেউ কেউ সত্যি সত্যিই সারা রাত মোটর চালিয়ে রাখত। জমিতে জল উপচে পড়ত। মাটির নীচের জল অস্বাভাবিক পরিমাণে তোলার ফলে জলস্তর নীচে নেমে যেতে লাগল। যে জল তুলতে আগে ১৫ মিনিট সময় লাগত, এখন সেই পরিমাণ জল তুলতে প্রায় একঘণ্টা লেগে যায়।
সর্বোপরি, পাড়ায় পাড়ায় ট্যাপকলের জল দিনে তিন বার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পড়ে যায়। সব ক’টার মুখ যে ভাঙা। প্রতি দিন কত জলের অপচয় হচ্ছে। মাটির তলা থেকে যদি দশ বালতি জল উপরে উঠে আসে, বিজ্ঞানমতে, তার মধ্যে দেড় থেকে দুই বালতি জল মাটির নীচ অবধি যেতে পারে। কিছুটা বাষ্প হয়ে মেঘে মিশে যায়। বাকিটা মাটির আবর্জনাতেই নষ্ট হয়ে যায়। এই ভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে জলের অভাবে মানুষ সহ বহু প্রাণী মারা পড়বে।
সে দিন আসার আগে আমাদের কিছু করতে হবে। আমাদের বাঁচতে হবে, অন্যদের বাঁচার পথ তৈরি করে দিতে হবে। সব এলাকার ভাঙা ট্যাপকলের মাথা লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এবং পথসভা করে করে সকলকে বর্তমান জলসঙ্কটের কথা বুঝিয়ে বলতে হবে। সকলে ট্যাপ থেকে জল নেওয়ার পরে যেন ট্যাপের মুখ বন্ধ করতে না ভোলেন।
কলকারখানার বিষাক্ত জল নদী ও ঝিলের জলে পড়ার ফলে কী ভাবে জল দূষিত হচ্ছে, সে বিষয়ে ছড়া-গান বেঁধে, পথনাটিকা করে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে।
সে দিন টিভিতে দেখাচ্ছিল, একটা ঝিলে প্রচুর ব্যাঙ বসবাস করত। হঠাৎ এক দিন দেখা গেল, হাজার হাজার ব্যাঙ মরে পড়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জলদূষণের ফলে ব্যাঙগুলো মারা গিয়েছে। তৈলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ে জাহাজের তেল নদী-সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। তা থেকে জলদূষণের ফলে নদী ও সামুদ্রিক প্রাণীকূল মারা যাচ্ছে।
মাটির তলা থেকে অতিরিক্ত জল তোলার কারণে জলে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ে। মাটির তলা ফোঁপরা হয়ে যায়। ফলে ভূমিকম্প দেখা দেয়। মাটির তলা থেকে অতিরিক্ত জল তুলতে থাকলে কোনও এলাকায় মাটির তলায় মিষ্টি জলের ভাণ্ডার কমে আসে। ফলে, আশপাশের অঞ্চল থেকে বিভিন্ন রকম খনিজ পদার্থ ও আর্সেনিক জাতীয় বিষাক্ত পদার্থমিশ্রিত জল শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য ছুটে আসে। তখন সেই আর্সেনিক-যুক্ত জল পাম্পের সাহায্যে উপরে উঠে আসতে থাকে। সেই জল খেয়ে শিশুদের ও বড়দের নানান রোগ দেখা দেয়। মাটির তলাকার ভারসাম্য নষ্ট হয়। মাটির তলায় জলের চাপ কমে গেলে উপরের মাটি হঠাৎ করে বসে গেলে তার ফলে কম্পন শুরু হয়। যেখানে-সেখানে ধস নামে।
এক দিন উত্তর-দক্ষিণ মেরুর বরফ ও গ্লেসিয়ারগুলি গলতে গলতে সমুদ্রের জলে এসে মিশবে। গ্রিনহাউস এফেক্ট বা সবুজঘর প্রভাব-সহ অতিরিক্ত এসি মেশিনের ব্যবহারে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেনের মতো ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে। তার ফলে সারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সেই তাপামাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছবে, হিমালয় ও মেরুপ্রদেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তখন মাটির তলাকার সুপেয় জলের পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনই বেড়ে যাবে উপরের জলের পরিমাণ। মেরু অঞ্চল-সহ আইসল্যান্ডের বরফের পাহাড় ও বরফের নদী গলতে শুরু করলে সব জল এসে পড়বে সমুদ্রের জলে। সমুদ্রের জল উপচে পড়বে নদীতে। নদীর জল উপচে পড়বে আশপাশের গ্রামের উপরে। সব গ্রাম বন্যায় ভেসে যাবে। মানুষ, গোরু, ছাগল সব জলে ডুবে মরতে শুরু করবে। তখন এই নীলগ্রহের নাম হবে কেবল জলজ নীল। জনশূন্য এই পৃথিবীর সেই সীমাহীন জলরাশি দেখার জন্য আর মানুষ থাকবে না।
পৃথিবীর কিছু দেশ আছে, যেমন আরব, ইরাক, ভারতের অসমের কিছু অঞ্চল, যেখানে মাটি খুঁড়লে জলের পরিবর্তে তেল ওঠে। সে দেশগুলিতে মাটির তলা দিয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে আমরা জল পাঠাই, পরিবর্তে ওই দেশগুলো আমাদের তেল পাঠায়। বিদেশে জল পাঠানোর কারণেও আমাদের জলসম্পদ ধীরে ধীরে কমছে।
ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সমাজের সকল মানুষ সচেতন হলেই সব সঙ্কটের সমাধান হবে। সর্বোপরি, সচেতন হতে হবে সকল বাবা-মায়েদের। ছোটরা যখন বাথরুমে ঢুকে একা একাই স্নান করে, কেউ বালতি থেকে জল তুলে ইচ্ছেমতো মাথায় ঢালতে থাকে। দেখা গেল, সেই জল গায়ে-মাথায় সামান্যই পড়ছে, বাকিটা পিঠের পিছনে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। কেউ আবার শাওয়ার চালিয়ে পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে চান করছে। কত জল নষ্ট হচ্ছে। অথচ, বাথরুমে ঢুকে বিশেষ করে ছোটদের যদি বাবা-মা স্থান করিয়ে দেন, তা হলে অল্প জলে ভাল স্নান হয়। নোংরা জামাকাপড় ধোয়া জল ফেলে না দিয়ে বাড়ির টবে বা মাটিতে লাগানো গাছে দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং, আমরা একটু সচেতন হলেই জলের অপচয় কমাতে পারি। আগামীর জলসঙ্কট রোধ করতে পারি। যাঁদের হাতে সময় আছে, তাঁরা রবিবার করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে এ ভাবে জল বাঁচানোর পদ্ধতি শেখাতে পারি। জল মূল্যবান। এর সঠিক ব্যবহার করে জলসম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা:
edit.nadia@abp.in
যে কোনও ইউনিকোড ফন্ট-এ টাইপ করে পাঠাবেন। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।