মহিলারা অবসাদ বা উৎকণ্ঠার ‘ডিসর্ডার’-এ ভোগেন ৪৯.৪%, যে হার পুরুষদের ক্ষেত্রে মাত্র ২২.১%। মহিলাদের আত্মহত্যার হার কিন্তু ৩৪%, যেখানে পুরুষদের হার ৭৮%। তবে কি মহিলারা শেষ অবধি লড়ার চেষ্টা করেন, না অবসাদ, বিষাদ, চোখের জল মেনে নেওয়ার অভ্যেস হয়ে যায়? নাকি-কান্না, ঘ্যানঘ্যান— এগুলো মহিলাদের আচরণ-বর্ণনা বা তিরস্কার করার জন্য ব্যবহৃত হয়। পুরুষরা কাঁদেন না, অথবা যেমনই কাঁদুন, নাকি সুরে কাঁদেন না, এবং কখনওই ঘ্যানঘ্যান করেন না— এ প্রায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। এখন আবার অনেকে পুরুষদের কাছ ঘেঁষে আলোচনা করেন ও বলেন, পুরুষরা দুঃখ পেলেও কাঁদতে পারেন না। কাঁদতে পারেন না, না কাঁদতে চান না?
মহিলাদের চোখের জলকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিয়েছে সমাজ। সবাই জানে, মাঝে মাঝেই মহিলাদের চোখে জল আসবে। অর্থাৎ, মহিলাদের চোখে জল আসার মতো ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটবে, এটাও স্বাভাবিক। প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন মহিলা ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের শিকার হন। ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা ধরনের ঘটনা যদি বাদও দিই (কারণ সে ক্ষেত্রে ফেলার মতো চোখের জল থাকে মনে হয় না), শুধু গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকারই হন ৭৭% মহিলা, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৪৬%-এর খবর শেষ অবধি নথিভুক্ত হতে পারে।
এক জন মহিলা গড়ে মাসে ৫.৩ বার কাঁদেন, আর পুরুষ কাঁদেন ১.১ বার। কিন্তু ‘ভাল’ মহিলাদের কান্না বিযয়ে সমাজের ফরমান: তাঁরা রেগে যাবেন না, প্রতিবাদ করবেন না, এমনকী ডুকরেও কেঁদে উঠবেন না। শুধু তাঁদের চোখে জল আসবে। সমাজের পক্ষে এটা বেশ সুবিধাজনক সেফটি ভাল্ভ। একটু কাঁদবে বই তো নয়, হয়তো সারা দিন ধরে চোখের জল ফেলবে, মুখ ভার করবে, ঘরের কোণে বসে মিনমিন করে একটানা আপত্তি জানাবে। মরতে তো আর যাবে না, তা হলে নয় থানা-পুলিশের ঝামেলা হত। ‘ঘ্যানঘ্যান কোরো না’ বলে কাটিয়ে দিলেই হল। মরে যান না, বা মরতে পারেন না তাঁরা, তাই তাঁদের আত্মহত্যার হার পুরুষদের চেয়ে কম। মহিলাদের হয়তো চরম অপমান বা নির্যাতনের মুহূর্তেও, অসহায় সন্তান বা বাবা-মা’র মুখ মনে পড়ে। কোনও কবি সেই কাঁদুনে মেয়ের জন্য কবিতা লেখেন না, ‘আট বছর আগের একদিন’-এর পোয়েটিক জাস্টিস থাকে না তাঁর কপালে। তিনি বেঁচে থাকেন, তাই তাঁর বেঁচে থাকাটা মহিমান্বিত হয় না, অনুল্লেখযোগ্য হয়ে যায়। চোখের জলেরা ক্রমে গুমরে থাকার পরিসংখ্যান সৃষ্টি করে, অবসাদ বা ডিপ্রেশনে ভোগেন ৪২%, অ্যাংজাইটি ডিসর্ডারে ৩৩%।
যাঁদের আমরা এত অত্যাচার করেছি, যাঁদের চোখের জল থামেনি, তাঁদের মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে বেঁচেছি। তাঁদের কথা বাদই দিলাম। তা ছাড়া অমুকের মা বড্ড অমিশুকে, অমুক পিসিমার খালি ধোওয়াধুয়ির বাতিক, ওই কাকিমা কী রকম আলুথালু হয়ে বাইরে বেরোন না রে?— এ সব কথা আমরা নিজেরা মেয়ে হয়েই নিজেদের বলি। অমুকের মা অমিশুকে কারণ তাঁর হয়তো চুপ করে নিজের মনে ভাবতে ভাল লাগে, মিশতে ভাল লাগে না। হয়তো যাঁর ঘরনি হয়ে এসেছেন, যে ঘরে এসেছেন, কোনওটাই তাঁর ভাল লাগে না। তাঁকে আপনি তাঁর ছোটবেলায়, তাঁর বাপের বাড়ির পাড়ায় দেখেছেন কি? তার পর নিজের রায় দিন। যে কাকিমা আলুথালু থাকেন, তেমন সাজেন না, তিনি কী অপরাধ করে ফেললেন? কাকু তো দিব্যি ঘামগন্ধওয়ালা, নোংরা টি-শার্ট পরে বীরবিক্রমে বাজার করতে চলে যান! কাকিমা হয়তো তাড়াহুড়োয় শাড়ি বদলাতে পারেননি, হয়তো চুলটা সকালে খুলে বাঁধা হয়নি— তাতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হল? সেখানেও ‘স্বাভাবিক’ হওয়ার সংজ্ঞা নিয়ে সমাজ অতিরিক্ত কড়া। ‘অমিশুকে’ হলেই হল? এক জন ‘মেয়েমানুষ’, যাকে কিনা সেজেগুজে থাকলেই ভাল দেখায়, সে শুধু নিজের ইচ্ছে হয়েছে বলে না সেজে থাকবে? চোখে লাগে না? এতটা অন্য রকম ব্যবহারের সাহসই বা তাকে কে জুগিয়েছে?
সুতরাং শুধু চোখের জল ফেলিয়েই ক্ষান্ত নয়, সমাজ এই না-স্বাভাবিক মেয়েদের মগজধোলাই যন্ত্রে ঢোকাতে চায়। এই যন্ত্রের আবার এখন অনেকগুলো হাতল। কখনও না-স্বাভাবিক মেয়েটির আশেপাশে ‘স্বাভাবিক’ মেয়েরা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিতে থাকে, কেন তার স্বাভাবিক হওয়া উচিত। কেন তার যথেষ্ট সাজগোজ করা উচিত। ইচ্ছে না থাকলেও, মতে না মিললেও, সবার সঙ্গে (‘সবাই’ বলতে মূলত মহিলা কিন্তু) হ্যা-হ্যা করা উচিত। না-স্বাভাবিক মেয়েটির আরও নিকট-বৃত্তের লোকজন (স্বামী, শাশুড়ি ইত্যাদি) তো ব্যস্ত থাকেনই বোঝাবার জন্য: একটা হাসিখুশি, সাজগোজ করা মেয়ে তাঁদের সংসারে এলে তাঁরা বেঁচে যেতেন। মেয়েটির হাসিখুশিকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে কত দিন সময় লাগত, সেটা অবশ্য বলেন না। এ ছাড়া মহিলাদের পত্রপত্রিকা ইত্যাদি তো আছেই বোঝাবার জন্য যে মেয়েদের ঠিক কেমন করে সাজগোজ করা উচিত, বরের বন্ধুরা এলে কী রান্না করা উচিত, শাশুড়িকে কতটা সময় দেওয়া উচিত...
চোখের জল বরফ হয়ে যেতে থাকে। সেই বরফের তলায় ক্রমশ চাপা পড়ে যেতে থাকে মেয়েটি। সে হয় অবসাদের শতকরা ৪২%-এর একটি হয়ে মরে, নয় মৃত্যুর ৩৪%-এর অংশ হয়ে বাঁচে। নয়তো পিসিমার মতো ক্রমাগত হাত ধুতে থাকে, যেন জলের ধারা তার হাত থেকে মুখ থেকে সরিয়ে নেবে সব অবসাদ, অপমানের চিহ্ন।
বৃথাই আশা। সম্ভবত বৃথাই এই সব আলোচনা। মনে রাখতে হবে, মা দুর্গা দেবী হয়েও পাঁচ দিনের বেশি বাপের বাড়ি থাকতে পারেন না, প্রতি বার কৈলাসে ফেরার সময় তাঁকে পর্যন্ত কনকাঞ্জলি দিয়ে বাপের বাড়ি থাকার ঋণ শোধ করে যেতে হয়, সেখানে আমাদের আর কতটুকু সাধ্য?
কেন চেয়ে আছো গো মা?