রামকৃষ্ণদেব।
রেডিয়ো খুলতেই প্রভাত সঙ্গীত বেজে উঠল— ‘‘কে এলো আলো করে কামারপুকুরে/ উলুদে শঙ্খ বাজা বরণ করে নে…’’
চতুর্দিক যেন সত্যিই আলোকিত হয়ে উঠল। যেমন ১৮৩৬-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্লপক্ষ, দ্বিতীয়া তিথির বুধবারে ঘটে ছিল ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে। পরে ভুবন আলোকিত হয়েছিল তাঁরই কৃপায়। ভগবান মর্ত্যধামে এলেন গীতার বাণী সত্য প্রমাণ করতে— “যদা যদা হি ধর্মস্য/ গ্লানির্ভবতি ভারত/ অভ্যুত্থানম অধর্মস্য/ তদাত্মানং সৃজম্যাহম….।”
পিতা ক্ষুদিরাম গয়ায় তীর্থ দর্শনে গিয়ে গদাধরের অলৌকিক দর্শন লাভ করেন। মাতা চন্দ্রমণি দেবীরও যুগীদের শিব মন্দিরে এক অলৌকিক জ্যোতিদর্শন ঘটে। এর পরই তাঁর গর্ভসঞ্চার হয় বলে তিনি মনে করেন। তাই এই নবজাতকের নাম রাখের গদাধর, গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ইনিই পরবর্তী জীবনে প্রেমের ঠাকুর পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
শৈশব থেকেই বালকের মধ্যে অন্য সমবয়সীদের তুলনায় অন্য রকম ভাব ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। পিতা-মাতার মতই সৎ, ধর্মপ্রাণ ও সরল স্বভাব বালকের সহজাত গুণ হয়ে ওঠে। পিতা ক্ষুদিরামের পৈতৃক নিবাস ছিল দেরে গ্রামে। সেখানকার জমিদার ক্ষুদিরামকে এক মিথ্যা মামলা জেতার জন্য সাক্ষ্য দিতে বলেন। কারণ, দরিদ্র হলেও এই সৎ ব্রাহ্মণের কথায় সকলেই মান্যতা দিতেন। কিন্তু ক্ষুদিরাম এই অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ান। জমিদারের হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। ফলে জমিদার তাঁকে আর এক মিথ্যা মামলায় সর্বস্বান্ত করে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেন। ন্যায়পরায়ণ ক্ষুদিরাম বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে, বন্ধুবর সুখলাল গোস্বামীর আহ্বানে স্বপরিবারে কামারপুকুর গ্রামে আসেন। সুখলালবাবুর বদান্যতায় এখানেই তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। সুখলাল গোস্বামী তাঁর বন্ধুকে চিরদিনের জন্য কিছু ধান জমিও লিখে দেন।
এই ভাবে বুঝি ভক্তের বোঝা ভগবানে বয়। পাঁচ বছর বয়সে বালক পাঠশালায় ভর্তি হয়। হাতের লেখা ছিল সুন্দর, ছবি আঁকায় দক্ষ এবং পিতার কাছে শাস্ত্র পাঠ বালককে অল্পকালেই জনপ্রিয় করে তোলে। ভবিষ্যতে এই বালকই পুরনো পুঁথির নকল করেন তার সুন্দর হস্তাক্ষরে, যা আজও সংরক্ষিত আছে। এত সত্ত্বেও বালকের গণিত বিষয়টি ভাল লাগত না। হিসেব-নিকেশ যে তার ধাতে সইত না তা বরাবরই বোঝা গিয়েছে। তাই বলতেন, ও সব চালকলা বাঁধা বিদ্যা আমার জন্য নয়। অর্থাৎ আখের গোছানো তাঁর কাজ নয়। তিনি যে এসেছেন আমাদের পথ দেখাতে, জীবনের আলো জ্বালতে, মানুষের চৈতন্য জাগ্রত করতে। বিষয়ী মানুষের স্বার্থবুদ্ধি তাঁর স্বভাবে সইবে কেন? প্রকৃতির রহস্যময়তা এই বালককে অভিভূত করে রাখে। কালো মেঘের মধ্যে উড়ন্ত বকের সারি দেখে বালক গদাধর আপ্লুত আবেগে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এই ভাবে বাল্য অবস্থা থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেশ, পরবর্তী কালে সমাধির সূচনা পর্ব।
সাত বছর বয়সে গদাধর পিতৃহারা হয়। ক্রমে বালকের মন অধিকার করে রাখে নির্জনতা ও চিন্তার আকুলতা। জমিদার বাড়িতে যাত্রাপালায় শিব সেজে অভিনয়ের সময় ভাবাবিষ্ট হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারায়। মৃৎশিল্পীদের শিখিয়ে দেয় কেমন করে দেবচকক্ষু আঁকতে হয়। শাস্ত্র আলোচনায় বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা সমস্যায় পড়লে বালক গদাধর সহজ কথায় তা সমাধান করে দেয়। সকলেই এই সব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত। তখন নারী ছিল অন্দরমহলের বন্দিনী জীব। কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গ তার অপরাধ। বালক গদাধর এই সংস্কার চূর্ণ করার জন্য এক দিন জমিদার বাড়িতে মেয়ে সেজে অন্দরমহলের মহিলাদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা গল্পগুজব করে আসে। ফেরার সময় ঘোমটা খুলে জমিদারকে দেখিয়ে যায় তিনি বালিকা নন, পাড়ার গদাধর।
জাতপাতের বেড়া ভাঙতে, তাঁর ধাইমা অব্রাহ্মণ ধনীকামারনিকে উপনয়নের সময় ভিক্ষামা হওয়ার জন্য জেদ ধরে। সকলে আপত্তি জানালেও বালক উপবীত গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। অবশেষে গদাধরের কথাই নায্য বলে সকলে মেনে নেন। ধনি হলেন ব্রাহ্মণের ভিক্ষামা।
১৮৫৫ সালে রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গদাধরের অগ্রজ রামকুমার এই মন্দিরের পূজারি নিযুক্ত হন। এই সময়ে দাদার হাত ধরেই গদাধর কলকাতায় আসেন। তাঁর আগ্রহেই প্রথমে বিষ্ণুমন্দির এবং পরে মা কালীর পূজাচর্নার কাজে যোগ দেন। শুরু হয় ধর্মসাধনা। তন্ত্র সাধনা, বৈদান্তিক সাধনার সব রকম সাধনার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। নানা ভাবে নানা পদ্ধতিতে ঈশ্বরের স্বরূপ দশর্নই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের লক্ষ্য। এমনকি, শুধু হিন্দুধর্ম নয়, খৃষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম সব পথেই তিনি ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য সাধনা করতে আরম্ভ করেন। পোশাক পরিবর্তন করে, আচরণ বিধি মেনে, তিনি নিজেকে ঈশ্বরের একনিষ্ঠ সেবক করে তোলেন। ব্রাহ্মসমাজের অগ্রণী পুরুষ কেশবচন্দ্র সেন বাস্তবিকই বলেছেন, তিনি ধর্মসাধনের জন্য যত ক্লেশ পেয়েছেন আর কোনও সাধক এত ক্লেশ সহ্য করেননি।
অবশেষে সব পথ ধরেই যখন ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করলেন, তখনই উপলব্ধি হল সকল ধর্মের উদ্দেশ্য এক ঈশ্বরপ্রাপ্তি। তাই সকল ধর্মই সমান ভাবে সত্য। সহজ সরল ভাষায় বললেন ‘যত মত তত পথ।’ অনুভব করলেন অগণিত ভক্ত তাঁর কাছে আসছে। এঁদের একদল গৃহী অন্য দল ত্যাগব্রতে দীক্ষিত সন্ন্যাসী। এঁদের দেখার জন্য ব্যাকুল ঠাকুর কেঁদে কেঁদে ডাক ছেড়ে বলেন ‘তোরা সব কে কোথায় আছিস আয়রে..।’ সেই জনস্রোত আজও আসছে। যে যেখান থেকে পারছে ছুটে আসছে ঠাকুরের পদতলে। ঠাকুর অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন প্রেম, ভক্তি আর মনুষ্যত্ববোধ।
ঠাকুরের তখন বয়স চব্বিশ। জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সারদাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। মা সারদা ছিলেন তাঁর সাধন পথের মূল সহযোগী। ঠাকুর, মা সারদাকে একদিন সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে, দেবী রূপে পূজা করেন। যখন সমগ্র দেশে নারী ব্যবহারের বস্তু বিশেষ, পুরুষের ভোগ্যা, অন্দরমহলের দাসি, অসম্মান আর অবজ্ঞার পাত্রী, তখনই ঠাকুর নারীকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঠাকুরের সহজ-সরল ভাষায় যাপন পথের উপদেশগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম), আজ যা গৃহীর বেদ ‘কথামৃত’।
ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে চাপরাস দিলেন— ‘নরেন শিক্ষে দিবে। যখন ঘরে বাইরে হাঁক দিবে’। হ্যাঁ, ঘরে বাইরে অর্থাৎ প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ) হাঁক দিয়েছিলেন। সেই হাঁক আজও ক্রমবর্ধমান। আমরা যদি সত্যি সত্যিই সেই হাঁক অনুভব করতে পারি তবেই আমাদের চৈতন্য হয়, মান এবং হুঁশ সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারি। নতুবা শুধু মাত্র ভক্তিতে গদগদ হয়ে ঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে আর দানের ভান করে, কাগজের পাতায় ছবি ও নাম ছেপে নিজের বড়াই করে লাভ কী? ঠাকুর আমিত্ব দূর করতে বলেছেন। তাঁর জীবন দিয়ে পালনও করেছেন। সে জীবন একই দেহে রাম ও কৃষ্ণের সম্মিলন। কোনও একটি সমস্যা নয়, একই সঙ্গে বহু সমস্যা সমাধানের পথ দেখালেন নিজের জীবন দিয়ে।
তাই তিনি অবতার শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ অবতার। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে উদ্দেশ্য করেই স্বামীজি শ্লোক লিখেছেন— “ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে/ অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ।’’
ঘূর্ণী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক