মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নুসরত জাহান। —ফাইল চিত্র।
তৃণমূল সাংসদ এবং টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরত জাহান সম্প্রতি পাবলিক বিতর্কের কেন্দ্রে। এক রথযাত্রার অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ইসলামের অবমাননা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে অনেকের কাছে। আবার অনেকেই নুসরতের এই কাজকে ‘সেকুলারিজম’-এর প্রকৃত উদাহরণ বলে মনে করছেন। এখন সমস্যা এখানেই যে, এই দুই পরস্পর-বিরোধী বক্তব্যকে একীভূত করে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সংখ্যাগুরুর লক্ষণগুলিকে যদি সংখ্যালঘু অনুসরণ করে থাকেন, তবেই কি তা এ দেশে ‘সেকুলার’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। আর সংখ্যাগুরু যদি সংখ্যালঘুর লক্ষণে নিজেকে তুলে ধরেন, তা হলে তা হয়ে দাঁড়ায় ‘তোষণ’ ও ‘ধান্ধাবাজি’? একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, খেলাটা খুব সরল নয়।
খেলাটা যেমন খুব সরল নয়, তেমনই বিষয়টাও খুব নতুন কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অন্য কোনও হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতার ইফতার পালন নিয়ে কম হইচই হয় না। মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে মমতার ছবি অথবা ফেজ টুপি পরে মোনাজাতরত অবস্থায় সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ট্রোল অতি কমন ব্যাপার। এই সব ছবি দিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর উদাহরণ প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু রথযাত্রায় নুসরতের অংশ নেওয়ার ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত তকমা প্রাপ্ত হয়েছে। সিঁদুর পরিহিতা নুসরতের রথযাত্রায় অংশগ্রহণকে ‘প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা’-র লক্ষণ বলে চিহ্নিত করছেন নেটিজেনরা। আর এখানেই বাধছে গোল। যে কারণে মমতা বা অন্যরা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়ে থাকেন, সেই একই কারণে নুসরত কী করে প্রশংসিত হতে পারেন— এই নিয়ে বিস্তর ধন্ধে পড়েছেন অনেকেই। কিছুদিন আগে সাংসদ হিসেবে শপথ গ্রহণের সময়ে শাঁখা-সিঁদুর পরিহিতা ‘হিন্দু নারী’-র বেশে নুসরতের উপস্থিতি ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণের ব্যাপারটা নিয়েও সরব হয়েছিলেন নেটিজেনরা, সরব হয়েছিল বেশ কিছু মিডিয়াও। ‘প্রকৃত সেকুলারের এমনটাই হওয়া উচিত’—এই মর্মে ঢাক পেটানো শুরু হয়েছিল। রথযাত্রা সেই ঢাকে কাঁসির সঙ্গত যুক্ত করল— এ কথা বলা যেতেই পারে।
তা হলে সেই চিরকেলে প্রশ্নটাই কি আবার উঠছে— ভারতে ‘সেকুলারিজম’ বস্তুটা আসলে সংখ্যাগুরুর দিকেই পাল্লা ভারী রাখে। নিজেকে সেকুলার হিসেবে প্রমাণ করতে গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদী লক্ষণগুলোর খাপে নিজেকে ফেলতে হবে। আর সংখ্যাগুরুকেও সচেতন থাকতে হবে, সংখ্যালঘুর লক্ষণে নিজেকে হাজির করা মানে ভোট ব্যাংক বাড়ানোর কৌশল— এই সমালোচনা উড়ে আসতে পারে যখন তখন? ব্যাপারটা ক্লিশে। কিন্তু একে এড়ানো যায় না কিছুতেই।
আরও পড়ুন: জগন্নাথদেবের রথ এবং বাঙালি সংস্কৃতি
সেকুলারিজমের বিষয়টা সবসময়েই ‘আশ্রয়ের রাজনীতি’-র সঙ্গে পৃক্ত। এখানে মনে হতেই পারে, সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি নুসরত সিঁদুর ইত্যাদি সংখ্যাগুরু-চিহ্ন ধারণ করে এবং রথযাত্রার মতো সংখ্যাগুরুর উৎসবে অংশ নিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন সংখ্যাগুরুর সমাজে। মজার ব্যাপার, নুসরতের এই কাজগুলিকে বাহবা দিয়েছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চেনামুখ সাধ্বী প্রাচী। তাঁর মতে, নুসরতের হিন্দু বিবাহ ও এই সব লক্ষণ ধারণ তাঁর হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হওয়াকেই বোঝায়। অথচ এই সব কিছুকেই নুসরতের ব্যক্তিগত অভিরুচি বলেও মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু গেল না। কারণ, নুসরত সাংসদ হয়ে নিজেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছেন, সেখানে তাঁর প্রতিটা কাজই ‘রাজনৈতিক’। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেরই রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হতে থাকবে। বলা যেতেই পারে, এখানে খেলা করছে ‘আশ্রয়ের রাজনীতি’। নুসরত এখানে এক ক্ষমতাবান ও বৃহতের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন এবং সেই বৃহৎ ও ক্ষমতাবান তাঁকে গ্রহন করছেন। ক্ষমতাবান এখানে ‘হোস্ট’, নুসরত নেহাতই অতিথি মাত্র। তলিয়ে দেখলে মনে হতেই পারে, সাধ্বী প্রাচী এখানে ‘হোস্ট’-এর ভূমকায় অবতীর্ণ। তিনি যেন তাঁর গৃহে আশ্রয় দিচ্ছেন নুসরতকে। শর্ত একটাই— তাঁর গৃহে তাঁর মতো করে বাস করতে হবে।
রথযাত্রা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৃণমূল সাংসদ নুসরত জাহান। —ফাইল চিত্র।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়তেই পারে কমল হাসান পরিচালিত ও অভিনীত ছবি ‘চাচি ৪২০’ (১৯৯৭)-এর কথা। এই ছবিতে এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে ব্রাহ্মণ পাচকের ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন এক মুসলমান বাবুর্চি। ধরা পড়ে যাওয়ার পরে কর্তা তাকে নিদান দিলেন, তাঁর বাড়িতে থাকতে হলে তাঁর মতো করেই থাকতে হবে। অর্থাৎ হিন্দু বিধি পালন করতে হবে। বাবুর্চি তাতেই সম্মত হন। কারণ, চাকরি হারালে তাঁর চলবে না। ইয়াকেও খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। বৃহৎ ও ক্ষমতাবানের কাছে তাঁর আত্মসমর্পণ অনিবার্য। এ ভাবেই ক্রমে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে, বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্রকে, তার হাতায় নিয়ে আসে। আর ক্ষমতাহীন ক্রমে হয়ে পড়ে ক্ষমতাবানের ছায়ায় লালিত এক সত্তা। সে নিজেকে হারায়। তার আত্মন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: গণ-আন্দোলনে নয়, নৈরাজ্য সৃষ্টিতেই উৎসাহ বিজেপির
সম্প্রতি আর এক ঘটনা ঘটেছে। বলিউডের নজরকাড়া কিশোরী অভিনেত্রী জাইরা ওয়াসিম জানিয়েছেন, তিনি সিনেমা জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছেন। আমির খান প্রযোজিত নীতেশ তিওয়ারি পরিচালিত ‘দঙ্গল’ (২০১৬) ছবিতে অভিনয়ের জন্য বিপুল প্রশংসা পেয়েছিলেন জাইরা। পরে ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ (২০১৭)-এ অভিনয়-সূত্রে এক নামজাদা বেসরকারি পুরস্কারও পান। কিন্তু তার পরে কী এমন ঘটল যে, তিনি তাঁর ফিল্মি কেরিয়ারে ছেদ টানতে চাইলেন? জাইরা এক দীর্ঘ ফেসবুক-বার্তায় জানিয়েছেন, বলিউডের পরিমণ্ডল, ফিলম জগতের পরিবেশ তাঁর ধর্ম ও বিশ্বাসের পক্ষে অনুকূল নয়। সেই কারণেই তিনি তাঁর ফিল্ম কেরিয়ারে ছেদ টানছেন। জাইরা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছর ধরে তাঁকে অন্য কেউ হয়ে উঠতে হয়েছে, যা তিনি নন। কথাটা ভাবার মতো। এই ‘অন্য কেউ’-টা কে? জাইরা একা নন, বলিউড এমনই এক ক্ষেত্র যা প্রতিটি মানুষকেই বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে তার নিজস্ব অবস্থান থেকে। জাইরার মতে, এখানে তাঁর ধর্ম ও বিশ্বাস ব্যাহত হচ্ছে। হতেই পারে। তার আদিকাল থেকেই বলিউড নিজের বুকে লালন করেছে হিন্দুত্ব। সুধীর কাকর, আশিস রাজ্যাধ্যক্ষ প্রমুখের গবেষণা অন্তত সেই কথাই বলে। সেখানে এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিশোরী যদি নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন বলে মনে করেন, সেক্ষেত্রে কিছু বলার থাকে না। তাঁর আশ্রয়দাতা বলিউডের হাঁকা নিদানগুলোকে কি নিতে পারলেন না এই কিশোরী? বেরিয়ে আসতে হল ‘আশ্রয়’ থেকে? নুসরত যেখানে আপস করে নিলেন, সেখান থেকেই কি ফেরত আসতে হল জাইরা কে? নিজেকে ‘অন্য’ করে তোলার কঠিন খেলায় হার মানলেন জাইরা।
আরও পড়ুন: এ বার দৃষ্টান্ত তৈরি করা জরুরি
তবে কি ধরে নেবো জাইরা যেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন, ঠিক সেখানেই নিজেকে প্লেস করলেন নুসরত? যে ইডিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করলেন জাইরা, সেই ইডিয়মকেই আঁকড়ে ধরলেন নুসরত? এ এক গভীর আর অন্তর্গহীনের খেলা। লস ও রিকভারি অফ সেলফ-এর গল্প। কখন মন হারায় আর কখন তাকে ‘অন্য’বস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়, তা বলা সত্যিই দুরূহ। এই হারানো আর খোঁজের খেলায় সবাই পেরে ওঠে না। জাইরা পারলেন না। নুসরত কি পারবেন? সময়ই উত্তর দেবে এই প্রশ্নের। ‘সেকুলারিজম’সেখানে একটা অছিলা মাত্র। একটা খাপ। একটা ফাঁদ। আপস করেই সেখানে পা দিতে হয়। পা দেওয়ার জন্য আপস করতে হয়।
রাষ্ট্রযন্ত্র জানায়, সংখ্যগুরু বা ক্ষমতাবানের দেওয়া ছাঁচে নিজেকে ঢালাই করতে পারলে ঠিক আছে। আর না পারলে তুমি দুয়ো, তুমি খেলা থেকে বাদ। আপসটা সংখ্যালঘুকেই করতে হয় বার বার। সংখ্যাগুরু যদি সংখ্যালঘুর ভেক ধরেন, সেটা ভেকই। ছেলেভুলোনোর রাজনীতি। কিন্তু সংখ্যালঘুকে বার বার গড়েপিটে নিতে হয় সংখ্যাগুরুর ধাঁচায়। না হলে সে অনিকেত। মাথার উপর থেকে ছাদ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ‘সেকুলারিজম’ এখানে একটা অলীক কল্পনা মাত্র। বড়জোর একটা দোহাই। নুসরতও এই দোহাইয়ের ফাঁদে। জাইরাও। বগা কেন্দে ফেরে ‘সেকুলারিজম’-এর ব্যাখ্যা চেয়ে।