দুর্বৃত্তরাজ ও দ্বেষভক্ত রুখতে

জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের অছিলায়, চলছে নির্ভেজাল ঘৃণার কারবার

যে কোনও ভিন্ন বক্তব্য শুনলেই সরকার ও তাদের মদতেপুষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলি মারমুখী হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মদতেপুষ্ট দলদাসেরা ধরেই নিয়েছে যে দেশের মানুষ শেয়ালতুল্য, যে শেয়ালগুলির এক রা হতেই হবে।

Advertisement

রণবীর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share:

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ষোলো বছর শিক্ষকতা করার সুবাদে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়টি নিছক কর্মস্থল ছিল না, তা কেবল মাত্র অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে দেয়নি। সেখানকার অগণিত ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী ও কর্মিবৃন্দের সাহচর্যে আমার মনন সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের উপর যে নির্মম ডান্ডাবাজির আঘাত পড়েছে, তার দ্বারা আমিও পীড়িত ও উৎপীড়িত। কোনও নিন্দা এবং ধিক্কারই এই জঘন্য পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট নয়।

Advertisement

একটা কথা পরিষ্কার। যে আক্রমণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ঘটল, এটি কোনও ক্ষিপ্ত জনতার তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ নয়। এটি পুরোদস্তুর প্রস্তুতিভিত্তিক কর্মপন্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বার হল তার উত্তর ফটক। আপনি যদি একা একা হেঁটে বা আপন গাড়িতে (যে গাড়ির সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার সেঁটে রাখা বাধ্যতামূলক) উত্তর ফটক দিয়ে না ঢোকেন, তবে আপনার পরিচয় ও গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রক্ষীবাহিনীর কাছে খাতায় কলমে নথিভুক্ত করাতে হবে। রেলস্টেশন থেকে বা বিমানবন্দর থেকে অটো বা ট্যাক্সি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে যত বার ঢুকেছি, তত বারই আমার গন্তব্য নথিভুক্ত করাতে হয়েছে। গত দুই বছর শুনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরদারির অত্যাধুনিক ব্যবস্থা বহু খরচ করে চালু হয়েছে। এই সুরক্ষা এড়িয়ে গুন্ডাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক নিয়ে মসৃণ ভাবে ঢুকে পড়ল কী ভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের চার পাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাঁচিল টপকে ঢোকা অসম্ভব।

অতএব, ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীটিকে জামাই আদরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ার ঢালাও ব্যবস্থা করে দেওয়া না হলে, এই হামলা চালানো অসম্ভব। বিশালায়তন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের লোকের পক্ষে রাস্তা দিয়ে ঢোকা-বেরোনো বেশ ঝক্কির বিষয়। অথচ গুন্ডাবাহিনী ঠিকঠাক পৌঁছে গেল বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রী আবাসে! বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভীষণ ও মিরজাফর জাঁকিয়ে না বসলে এই সুলুকসন্ধান বাইরের মানুষ পাবেন কী করে? যারা হামলাবাজি করল, তারা আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষ না। আপনি-আমি রাগের চোটে সুচিন্তিত ভাবে বেছে বেছে মহিলা ছাত্রী ও অধ্যাপিকার মাথায় লাঠি বসাতে পারব না। এরা পেশাদারি গুন্ডা ও হামলাবাজ। এই গুন্ডাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে হামলা করার যাবতীয় মদত প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন ভাবে না দিলে এই ধ্বংসলীলা ঘটা অসম্ভব।

Advertisement

যে কোনও ভিন্ন বক্তব্য শুনলেই সরকার ও তাদের মদতেপুষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলি মারমুখী হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মদতেপুষ্ট দলদাসেরা ধরেই নিয়েছে যে দেশের মানুষ শেয়ালতুল্য, যে শেয়ালগুলির এক রা হতেই হবে। যে মুহূর্তে সকলে হুক্কা হুয়া বলবে না, তখনই তারা দেশের শত্রু। তাঁদের জন্য হুমকি; পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব।

কয়েকটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের কথা না বললেই নয়। ১৯৪৭-এ রক্তগঙ্গার মধ্য দিয়ে যখন দেশভাগ ও স্বাধীনতা এল, তখন ভারতের হিন্দুদের জন্য থাকার ও যাওয়ার একটিই দেশ ছিল— সেই দেশ ভারত। অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের কাছে তাঁরা কোথায় থাকবেন বা যাবেন তার দু’টি বিকল্প ছিল— হয় ভারত নয় পাকিস্তান। বহু মুসলমান পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে অবিভক্ত ভারত ছেড়েছিলেন। একই ভাবে বিশাল সংখ্যক মুসলমান ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারও দয়া বা কৃপা ভিক্ষা না করে। তাঁরা আদ্যন্ত ভারতের মানুষ, তাঁদের এই দেশ থেকে চলে যেতে বলার অধিকার কারও নেই। পাকিস্তানে চলে যাওয়ার উপদেশ যারা জোর গলায় দিয়ে চলেছেন তাঁদেরকে বলি, আপনারা ভারতের উত্তরের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ নেপালে চলে যাচ্ছেন না কেন? ভারত হিন্দু রাষ্ট্র নয়, কিন্তু ২০১৫-র আগে পর্যন্ত নেপাল সারা দুনিয়ার মধ্যে একমেবাদ্বিতীয়ম্ ঘোষিত হিন্দু রাজ্য ছিল। নেপালের মানুষ এখন আর হিন্দু রাজ্যের অংশীদার নন। নেপাল যা সংবিধানের মাধ্যমে পরিত্যাগ করতে পারল, তা এ বার এই দেশের উপর চাপানো হবে? হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যাঁরা মশগুল, তাঁরা নেপালে গিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র পুনঃস্থাপনে আরও সফল হোন। এর থেকে ‘ঘর ওয়াপসি’-র ভাল নজির হিন্দুত্বপন্থীরা আর পাবেন না।

দেশের অর্থনীতি নোটবন্দি ও জিএসটি-র দৌলতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন পেঁয়াজ কত দামে ও কোথায় কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, এই প্রশ্ন তুললেই আপনি ‘দুশমন’। আর দুশমনকে দাবিয়ে রাখার সেরা উপায় নিজের গায়ে দেশভক্তের তকমা লাগিয়ে অন্যদের ধোলাই শুরু করা। অর্থনীতির হাল যতই সঙ্গিন, ততই হিন্দুত্বের হুঙ্কারে কান পাতা দায়। এই দেশে কে নিরাপদ? নারীরা নিরাপদ? পাগলেও এ কথা বলবে না। যত ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর বুলি কপচানো হচ্ছে, ততই নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা বেপাত্তা হচ্ছে। ভারতে মুসলমান ও দলিতদের উপর যে ঘৃণা ও নির্মমতা এখন প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় উন্নীত, তার পরিচয় গোটা দুনিয়া জানে। প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর শেষকৃত্যের কথা মনে পড়ে? প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে ভারতীয় জনতা পার্টির সদর দফতরের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে সর্বজনসমক্ষে বেধড়ক মার খেয়েছিলেন গেরুয়া পরিহিত স্বামী অগ্নিবেশ। তখনও একই ধুয়ো শোনা গিয়েছিল; ক্ষিপ্ত কিছু মানুষের হাতে স্বামী অগ্নিবেশ প্রহৃত ও লাঞ্ছিত।

একই ভাবে জেএনইউয়ের হামলাকারীদের বলা হচ্ছে উন্মত্ত, ক্ষিপ্ত জনতা। সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা ভাষণ। এরা সুদক্ষ, প্রশিক্ষিত, পেশাদার হামলাবাজ, ক্ষমতাসীনদের মদতেপুষ্ট। তাই এরা মসৃণ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে, হামলা চালায় এবং কেল্লা ফতে করার ভঙ্গিতে নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে পড়ে। হামলাকারীরা নিঃসন্দেহে জানে যে তাদের ছবি উঠবে, শনাক্তও করা যাবে। কিন্তু তারা আরও নিশ্চিন্ত এবং নির্ভার যে, যাদের পরিচালনায় তারা এই নারকীয় কাণ্ড ঘটাল, তারাই এই গুন্ডাবাহিনীকে রক্ষা করবে।

ডান্ডাবাজির ভয় দেখিয়ে, জুলুম করে ভারতের মানুষকে কিন্তু দমানো যাবে না। ভারতের মানুষ গত সাড়ে পাঁচ বছর প্রায় মুখ বুজে অনেক অনাচার ও অবিচার দেখেছেন। এই প্রথম সমবেত হয়ে তাঁরা নানা প্রশ্ন তুলছেন। প্রশ্ন তুললেই দেশদ্রোহী তকমা লাগানোর জন্য তো সরকার ও তাদের দলদাসবৃন্দ এক পায়ে খাড়া। কিন্তু প্রশ্ন তোলা তাতে বন্ধ হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মানুষকে প্রশ্নশীল করে তোলে। জেএনইউয়ের খ্যাতি ও সাফল্যের প্রধান ভিত্তিই হল নিরন্তর প্রশ্ন তোলা। বিতর্ককে কণ্ঠরোধ করা নয়, বিতর্ককে সজীব রাখা, যাতে নতুন ভাবনা জন্ম নেয়, যাতে মনের জানালাগুলি খোলা থাকে। তার ক্ষীণতম সম্ভাবনা থাকলেই দেশভক্তদের আক্কেল গুড়ুম। অতএব চালাও হুমকি, আর লাগাও ডান্ডা। কখনও উর্দিপরা পুলিশের নির্যাতন, কখনও মুখ ঢাকা দেওয়া গুন্ডাদের আস্ফালন: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক ও অভিন্ন রূপ দিবালোকের চেয়েও প্রকট।

ফ্যাসিবাদী চিন্তায় ও প্রয়োগপদ্ধতিতে স্বকীয় চিন্তার কোনও স্থান নেই। জেএনইউ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রতিবাদী মানুষের মিছিলে যে বর্বরতা চলেছে, তা তাৎক্ষণিক, আকস্মিক নয়। ফ্যাসিবাদী ব্যাকরণ মেনেই তা ঘটানো হচ্ছে।

১৯৪৭-এ মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে দেশভাগ ও স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু হিন্দুত্বের সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও সর্বনাশী তত্ত্বে ও প্রয়োগে দেশ হয়তো এ বার ভাগ হয়ে যাবে মহল্লায় মহল্লায়। দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের মোড়কে আর আড়ালে, হিন্দুত্বের অছিলায় যা চলছে, তা নির্ভেজাল ঘৃণার কারবার। এই ঘৃণা কোনও ব্যক্তির মানসিকতা নয়, এটি একটি ক্ষমতাদখলের ভাবাদর্শ। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা ও কর্মপন্থায় পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে জাতি-উৎকর্ষের মোহ এবং ‘অপর’-কে ঘৃণা। বার বার ভাবা দরকার কেন ‘চার অধ্যায়’-এ অন্তুর মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন, ‘তোমরা যাকে পেট্রিয়ট বলো, আমি সেই পেট্রিয়ট নই।’ অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষ যখন দেশভক্তির আধার হয়, যখন প্রতি পলে দেশের ভিতর ও বাইরে দুশমন চিহ্নিত করে ভয়াবহ আর্থিক অবস্থাকে আড়াল দেওয়ার চাতুরী চলতে থাকে, তখন ধর্মসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমের জোয়ার চাগিয়ে উঠবে।

অপরিসীম বেদনায় কথাগুলি লিখলাম। কী জানি লেখকের উপর কী হামলা নেমে আসবে। জাতীয়তাবাদী দেশভক্তেরা একটা গান সমস্বরে গাইতে গাইতে প্রশ্নশীল দেশবাসীকে ঠেঙাতে পারেন। বহু উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গানের রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তীব্র ধিক্কারে ও ব্যঙ্গে গানটি লিখেছিলেন: ‘‘এ বার হয়েছি হিন্দু/ করুণাসিন্ধু!/গোবিন্দজীকে ভজি হে!/ এখন করি দিবারাতি/ দুপুরে ডাকাতি/ (শ্যাম) প্রেম-সুধারসে মজি হে!’’

আসুন, আমরা যারা নিরস্ত্র, যারা অহিংস, যারা দলদাস নই, তারা মাথা উঁচু করে, শিরদাঁড়া সটান রেখে ক্ষমতাধরদের জানান দিই যে মানুষের চেয়ে দেশভক্তি বড় নয়। যে দেশভক্তির চালিকাশক্তি তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর নির্লজ্জ আস্ফালন, তা অচিরে টুকরো টুকরো করে দেবে স্বদেশকে।

আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বাদশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ যে ছোট কবিতার মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন, তার থেকে চার পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করছি এই আশায় যে, আমরা জীবনযাপনে বহুত্বকে, বিভিন্নতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ ও পালন করব: ‘‘স্বদেশেরে চাও যদি,/ তারও ঊর্ধ্বে ওঠো।/কোর না দেশের কাছে/ মানুষেরে ছোট।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement