আমপান ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক পরিমাপ অন্তত ৯০ হাজার কোটি টাকা। মাঠের ফসল প্রায় সবটাই নষ্ট। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসংখ্য গাছ উপড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বিপন্ন। ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি সুন্দরবন অঞ্চলে। শত শত গ্রাম জলমগ্ন, অধিকাংশ বাড়ি ধূলিসাৎ। পানীয় জলের উৎস, কৃষিজমি, পুকুর সব নোনাজলের কবলে চলে গিয়েছে। অতিমারির ফলে গ্রামীণ মানুষের কৃষি, অকৃষি রোজগার, ও ভিনরাজ্যের রোজগার মার খেয়েছিল। আমপান খেতের ফসল নষ্ট করে সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে। অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে গ্রামের গরিব মানুষ ক্ষুধা ও অনাহারে ডুবে যাবেন। এখনই ত্রাণ এবং উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে, শুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করতে হবে। তার পর চাই পরিবেশ-সহনশীল ব্যবস্থা গ্রহণ।
এই বিপত্তির মধ্যে পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা কেন? যত দূর জানা গিয়েছে, আমপানের তীব্র গতি ও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা অর্জনের পিছনে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপরিভাগের তাপমাত্রায় অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৭-২৮ ডিগ্রি থেকে ৩২-৩৪ ডিগ্রিতে পৌঁছেছিল। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, যার অনেকটাই ঘটিয়েছে মানুষ। তাপমাত্রার বৃদ্ধি অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে ফের তীব্র গতির ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দিতে পারে। তাই তার মোকাবিলায় এখন থেকে প্রস্তুতি দরকার। বিপর্যয় মোকাবিলা নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। তবু বিপর্যয়-প্রতিরোধী কৃষিব্যবস্থার জন্য তাৎক্ষণিক, সুদূরপ্রসারী— দু’রকম ব্যবস্থার কথাই বলব।
সবচেয়ে বিপন্ন সুন্দরবন। সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলার শেষ-সীমায় পৌঁছে যাওয়া মানুষের কাছে বোধ হয় নোনা-প্রতিরোধী চাষাবাদ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সেখানে ক্ষতিপূরণের আলোচনায় জোর দেওয়া প্রয়োজন সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ফেরানোর ওপর। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। আর ম্যানগ্রোভ অবলুপ্ত হলে ক্ষতির পরিমাণ বহু গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
রাজ্যের অন্যত্র যেখানে জমি আছে, আর জল নোনা নয়, সেখানে বিপর্যয় প্রতিরোধের উপযোগী অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব। প্রথমত, ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে সরকার কৃষিবিমার বন্দোবস্ত করতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে ফসলের বিমা চালু করতে পারে। ক্ষুদ্র জমি-মালিকানার প্রেক্ষিতে এই বিমা ব্যক্তি-ভিত্তিক না হয়ে গ্রাম-ভিত্তিক করার কথা ভাবা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার মুখে সেচের নিশ্চয়তা-প্রদান চাষির স্বার্থরক্ষার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। বর্ষার খামখেয়ালিপনার জন্য বৃষ্টি-নির্ভর আমন ধানের চাষেও এখন সেচের ব্যবহার বাড়ছে। আনাজের মতো অর্থকরী ফসলের চাষেও সেচের নিশ্চয়তা জরুরি। সৌভাগ্যক্রমে পশ্চিমবঙ্গে মাটির ওপরে ও নীচে জলসম্পদ অপ্রতুল নয়। এই অবস্থায় সেচব্যবস্থার আরও প্রসারের স্বার্থে অন্তত আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য সেচের বিদ্যুতের মাশুল কমানো প্রয়োজন। এই রাজ্যে কৃষিতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মাশুল বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে একেবারে ওপরের দিকে, যা কৃষকদের পর্যাপ্ত ভূজল ব্যবহারের অন্তরায়।
তৃতীয়ত, মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইন সংশোধন করে বছরে ১৫০-২০০ দিন কাজের সুযোগ তৈরি করা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে জরুরি। সঙ্গে ওই প্রকল্পে অনুমোদিত কাজের তালিকায় ব্যক্তিগত জমি অন্তর্ভূক্ত করা হোক। এর ফলে প্রথমত লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক, যাঁরা করোনার কারণে গ্রামে ফিরে এসেছেন বা আসছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, গ্রামের রাস্তাঘাট, পুকুর, সামাজিক পরিকাঠামো ও আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত বাসস্থানের পুনর্নির্মাণ সম্ভব হবে। ঘূর্ণিঝড়ে আনুমানিক ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ গাছ উৎপাটিত হয়েছে। মনরেগা-র ফান্ড পুনরায় বনসৃজনে কাজে লাগবে।
অতএব রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় উদ্যোগী হতে হবে, যাতে মনরেগা-র অধীনে কাজের দিন বৃদ্ধির সঙ্গে কাজের তালিকা বিস্তৃত করা যায়। এর একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতে পারে জল-সংরক্ষণের বন্দোবস্ত, যা রাজ্য সরকারের ‘জল ধরো, জল ভরো’ কর্মসূচিতে গতিসঞ্চার করবে, চাষের কাজে ভূজলের নিবিড় ব্যবহারের পাশাপাশি তার পুনঃসঞ্চয় নিশ্চিত করবে।
জল ব্যবস্থাপনা রাজ্যের পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’-সহ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সাহায্যদাতারা এগিয়ে আসতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিশ্বের বিপন্নতম এলাকাগুলির একটি বঙ্গীয় উপত্যকা। সেখানে পরিবেশ-বান্ধব কৃষি ও খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও সঙ্গে নেওয়া চাই, যাতে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের কাজে লাগতে পারে। সঙ্কট যখন বৃহৎ, তখন তার মোকাবিলায় বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন বইকি।
গবেষক, ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট