বিষয়পুরের বহুরূপীরা ‘ব্যাধ’ পরিচয় ছাড়েননি

বিষয়পুর গ্রামের মানুষেরা বহুরূপীদের এই পাড়াটিকে ‘পাখমারাদের পাড়া’ বলেই জানেন। পুরুষানুক্রমিক বহুরূপী দেখানো এই মানুষগুলি সেই ধারাটি অব্যাহত রেখেছেন। ‘পাখমরা’ শব্দটি যে পাখি মারা থেকেই এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই। চেহারা দেখে মনে হয়, তাঁরা মঙ্গল জাতীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত কিরাত। লিখছেন গৌর গোপাল পাল।আগে এই বহুরূপীরা অনেকেই তাবিজ-খুপি, জরি-বুটি বিক্রির পাশাপাশি ভালুক-বাঁদর-ধনেশপাখি নিয়ে খেলা দেখিয়েছেন। যাযাবর-শিকারজীবী এই জনগোষ্ঠী সমতলে এসে  খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন জীবিকা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪১
Share:

বহুরূপীর দল। নিজস্ব চিত্র

আমাদের সমাজে এখনও এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বিভিন্ন রূপ ধরে নানা অঙ্গ-ভঙ্গি সহকারে মানুষের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি যৎসামান্য অর্থ উপার্জন করে নিজেদের পেট চালান। এঁদেরই আমরা বহুরূপী বলি। লাভপুর থানার বিষয়পুর গ্রামে এ রকমই ৩০-৩৫ ঘর বহুরূপীর বাস। এঁরা নিজেদের ‘ব্যাধ’ হিসেবেই পরিচয় দেন। তফিসিলি জনজাতিভুক্ত এই মানুষজন অতীতে নিজেদের পদবিতে ‘ব্যাধ’ লিখতেন। এখন কয়েক পুরুষ হল পদবি ‘চৌধুরী’ লিখছেন। তবে, বন্ধনীর মধ্যে ‘ব্যাধ’ লিখে, তাঁদের সেই ট্র্যাডিশন আজও বজায় রেখে চলেছেন।

Advertisement

আগে এই বহুরূপীরা অনেকেই তাবিজ-খুপি, জরি-বুটি বিক্রির পাশাপাশি ভালুক-বাঁদর-ধনেশপাখি নিয়ে খেলা দেখিয়েছেন। যাযাবর-শিকারজীবী এই জনগোষ্ঠী সমতলে এসে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন জীবিকা। বিষয়পুর গ্রামের মানুষেরা বহুরূপীদের এই পাড়াটিকে ‘পাখমারাদের পাড়া’ বলেই জানেন। পুরুষানুক্রমিক বহুরূপী দেখানো এই মানুষগুলি সেই ধারাটি অব্যাহত রেখেছেন। ‘পাখমরা’ শব্দটি যে পাখি মারা থেকেই এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই। চেহারা দেখে মনে হয়, তাঁরা মঙ্গল জাতীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত কিরাত। আজও হিমালয়ের সানু অঞ্চলে গন্ধর্ব-কিন্নর-কিরাত জনগোষ্ঠীর মানুষদের খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। আর-ডি-হাইম ১৮৭৮ সালে লাভপুর থানার বিবরণে ৩৬১৮টি পরিবারকে হিন্দু সমাজের অন্ত্যজ পরিবার বলে উল্লেখ করেছেন। তখন মাত্র তিরিশটি পরিবার ছিল ‘ব্যাধ’ পর্যায়ভুক্ত। ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশা, ইলামবাজারের দেবীপুর, নলহাটির সরধা, নানুরের খুজুটিপাড়াতেও ‘ব্যাধ’ সম্প্রদায়ভুক্ত জনজাতির বাস আছে।

বিষয়পুরের ব্যাধ-বহুরূপীরা ময়ূরাক্ষীতে মৃতদেহ দাহ করেন এবং নদীতেই অস্থি বিসর্জন দেন। তবে কবর দেওয়ার প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। ডোম, শবর, পুলিন্দ, নিষাদ, বেদে, ব্যাধ প্রভৃতি তথাকথিত অন্ত্যজ বর্ণ যাযাবরদের অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ খেলানো জাদুবিদ্যার নানা খেলা ও ভোজবাজি দেখানো। তাই এ দেশের নিম্নকোটির যাযাবর জাতিরা বিভিন্ন সময়ে বীরভূমে এসে এখানে স্থায়ী ভাবেই রয়ে গেছেন। মৌর্য ও নন্দ বংশের রাজারা বঙ্গদেশ শাসন করেছেন আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে—এমন প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে। বঙ্গ ও মগধ দেশের মানুষকে অসুর বলে বর্ণনা করা হয়েছে ‘ঐতরেয় আরণ্যক’- এ। সেখানে দস্যু বলা হয়েছে উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রজনদের। বীরভূম, বাঁকুড়ায় অসুর নামাঙ্কিত বহু গ্রামের সন্ধান আজও পাওয়া যায়। অতীতে বীরভূমের দক্ষিণ অংশ কামকোটি এবং উত্তরাংশ মৎস্যদেশ নামে পরিচিত ছিল। কঙ্কালীপীঠ কাঞ্চীদেশ বা কামকোটির অন্তর্গত এবং কলেশ্বর উত্তরাংশ বা মৎস্যদেশের অন্তর্গত ছিল। মধ্যোত্তর বীরভূমের অন্তর্গত ছিল পাঞ্চাল দেশ, যা আমরা ঐতিহাসিক অতুল সুরের লেখা থেকে জানতে পারি।

Advertisement

বহুরূপীদের বিষয়পুর গ্রামটি তখন কাঞ্চী বা মৎস্য দেশের অন্তর্গত ছিল। লাভপুরের বিষয়পুরের উল্লেখ রয়েছে ষোড়শ জনপদেও। ‘ব্যাঘ’-দের এই চৌধুরী পদবি সম্ভবত নবাব বাদশাহদের দেওয়া। এঁরা মহাভারতের জরাসন্ধ ব্যাধের বংশধর বলেই নিজেদের দাবি করেন। বাদল সাহার লেখা থেকেও তাই জানা যায়। এঁদের আদি নিবাস ছিল গুজরাত। ভারাটে পদাতিক সৈন্য হিসাবে কোনও এক নবাব-বাদশাহর আমলে তাঁদের এখানে আনা হয়। নবাবি আমল শেষ হলে তীর-ধনুকের যুদ্ধের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। কিন্তু, এই ব্যাধেরা টিকে যান এই বাংলার মাটিতে। কিছু মানুষ বীরভূমের বিষয়পুরকে বেছে নিলেও জীবন জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ বর্ধমানের দাঁইহাট, কেউ বা মুর্শিবাদের জঙ্গিপুরকেও বেছে নিয়েছিলেন। বিষয়পুরের পাখমারাদের পাড়ায় ঢুকলে আজও চোখে পড়বে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রুজি রোজগারের জন্য বহুরূপী সেজে মুখে রং মেখে ভিন্ গাঁয়ের পথে পাড়ি দিচ্ছে অথবা কেউ তীর-ধনুক নিয়ে খেলা করেছে। বংশধারায় এই নেশায় বাঁচার তাগিদে কেউ যেমন পাখি শিকার করছেন, তেমনই কেউ কেউ বহুরূপী সেজে দুটো চাল-কলাই-পয়সার জন্য হন্যে হয়ে লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এঁদের ভাষা মূলত বাংলা হলেও নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের সময় গোপন এক দুর্বোধ্য ভাষা ব্যবহার করতেও দেখা যায়। এঁরা বাদুড়কে হিলকে বলেন, তেমন টাকাকে বলেন বকরি, জলকে বলেন চিয়েন, মুড়ি তাঁদের কাছে নিবুজে, মাংস হল চড়াই। ভাতের নাম কুনুয়া। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে বিচার করলে বিষয়পুরের ব্যাধ সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতির এই ধারাটির ভূমিকাও অবহেলার নয়। সরকারি উদ্যোগে তুষার চট্টপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে প্রথম রাজ্য বহুরূপী সম্মেলন হয় ৯ এবং ১০ই অক্টোবর, ১৯৮৮ সালে। সাংস্কৃতিক সংস্থা বা উৎসাহী পৃষ্ঠপোষকেরা আলাপ-আলোচনায় তাঁদের সঙ্গে বসতে শুরু করেন তখন থেকেই। সেদিনের সম্মেলনে এ রাজ্যের ৫৬ জন বহুরূপী প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নদিয়ার ১ জন, বর্ধমানের ২১ জন, মুর্শিদাবাদের ৮ জন, এবং বীরভূমের ২৬ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নেন।

জৌলুসহীন বিবর্ণ জীবন-যাপনে বাধ্য এই বহুরূপী সম্প্রদায়ের বিনিময় যোগ্য পণ্যবস্তু দেওয়ার সুযোগ আসেনি। অভিনয়-নাটক-সংলাপ সাজসজ্জার সঙ্গেই শুধু তার যোগ। একান্ত ভাবেই প্রান্তীয় নিম্নবর্গের এক শ্রেণির মানুষ পেট ভরানোর তাগিদে মুখে রং মেখে বহুরূপী সাজতে বাধ্য হয়েছে। প্রথম বহুরূপী রাজ্য সম্মেলন হওয়ার পরে আমজনতার নজর পড়ে লোকশিল্পী বহুরূপীদের প্রতি। সেই সম্মেলনের প্রচারপত্র থেকে জানা যায় বহুরূপীদের প্রথম সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী?

প্রথমত, প্রাথমিক ভাবে বহুরূপী বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলিকে সংগঠিত করা। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষকে এই লোকশিল্প ও শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলে বৃত্তিটির শিল্পগত দিকটি সম্পর্কে সচেতন করা। তৃতীয়ত, বহুরূপী শিল্পের মান উন্নয়ন করে তাকে সময়োপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা। এই প্রচারপত্রে বহুরূপীদের পক্ষ থেকে তাঁদের লোকশিল্পী হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া এবং দুঃস্থলোক শিল্পী হিসেবে বহুরূপীদের সরকারি সহায়তার আওতায় আনার দাবিও সরকারের কাছে পেশ করা হয়। এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অধ্যাপক সত্রাজিৎ গোস্বামী, নির্মল সরকার ছিলেন আহ্বায়ক। এ সব তথ্য সত্রাজিৎ গোস্বামীর লেখা থেকেই জানা যায়।

যাযাবর এই বহুরূপী সম্প্রদায়টিকে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ব্রজেশ্বর রায় এখানে নিয়ে আসেন বলে তথ্যে জানা যায়। কৃষিকাজে অদক্ষ হতদরিদ্র এই ব্যাধেদের বহুরূপী দেখানোই জীবিকা বা পেশা। ২০০০ সালে বিষয়পুরের বহুরূপীরা ব্যাধ হিসাবে সার্টিফিকেট পান। বছরে এঁরা তিন বার গ্রামে ফিরে আসেন। একবার ধরম পুজোর বুদ্ধ পূর্ণিমায়, একবার লবানে এবং ভোট থাকলে আর একবার। আগে এঁদের বিয়েতে পণ লাগত না। কন্যাপণ থাকলেও তা ছিল মাছ ধরার জাল, তীর-ধনুক, শিকারের সাতনলি, পাঁচ পোয়া ধান, পাঁচ সিকে নগদ এইসব। তবে এখন বিয়ে দিতে নগদ টাকা, মদ, আংটি, ঘড়ি, সাইকেল আরও কত কিছুই দিতে হয়। বিষয়পুরের বহুরূপীদের সাজ-পোশাক কেনার পয়সা জোটে না। লোকনাট্যের পথ-প্রদর্শনী করেও ভিক্ষুকের চেয়ে বেশি সম্মান অর্জন করতে পারেনি এখানকার বহুরূপীরা। তবে বিষয়পুরের ৪২ জন ব্যাধ বহুরূপীকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শংসাপত্র দেওয়ার পাশাপাশি তফসিলি জনজাতির কার্ড এবং নগদ ১১ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। বীরভূম জেলাতেই প্রথম ৪২ জন বহুরূপী সরকারি ভাবে সচিত্র পরিচয়পত্র পেয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেশনকার্ড ও সচিত্র পরিচয়পত্রও পাওয়ায় এখন একটু খুশির হাওয়া বইতে শুরু করেছে বিষয়পুরের এই পাখমারাদের পাড়ায়। এখনও দু’বেলা দু’মুঠো পেট ভরে খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা হয়ে ওঠেনি এই রাজ্যের সমস্ত যাযাবর বেদে ব্যাধ বহুরূপীদের। তবু বিষয়পুরের বহুরূপীরা সে দিক দিয়ে তাঁদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে।

বিষয়পুর তথা বাংলার বহুরূপীদের বিশদ খবর জানতে আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলার বহুরূপী’ বইটি বহুরূপী সমাজের একটি আকর গ্রন্থ। আশার কথা, বিষয়পুরের ব্যাধ বহুরূপীদের ছেলে-মেয়েরা এখন পড়াশোনায় মন দিয়েছে। বাণী চৌধুরী (ব্যাধ) যেমন বি-এ পাশ করেছেন। চাঁদু চৌধুরী (ব্যাধ)তো কবেই সেই ১৯৭৮ সালে এইট পাশ করেছেন। সুমিত্রা চৌধুরী (ব্যাধ) মাধ্যমিক পাশ করে অঙ্গনওয়াড়িতে কাজ করছেন। সরস্বতী চৌধুরী মাধ্যমিক, গোবিন্দ চৌধুরী ইলেভেনে, গৌরাঙ্গ চৌধুরী নাইন, শ্রাবণী, কৌশল্যা চৌধুরী (ব্যাধেরা) এখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ওই সম্প্রদায়ের চাঁদু, নবকুমার, ছোটন, অমর, সূর্য, রাজেন্দ্র, অশোক, লাল্টুদের মুখ থেকে সে রকমই তথ্য উঠে এল। তবে আফশোস ওঁদের অনেকেই এখনও রাজ্য সরকারের লোকপ্রসার প্রকল্পের কার্ড পাননি। ভাতাও পাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ কার্ড না পেলেও ভাতা পাচ্ছেন। বিষয়পুরের বহুরূপীদের লোকসংস্কৃতির এই ধারাটি বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারকে আরও একটু উদ্যোগী হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বহুরূপী শিল্পীরাও দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে হারিয়ে যাওয়া এই লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।

লেখক সাহিত্যকর্মী ও প্রাক্তন সেচকর্মী, মতামত নিজস্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement