সন্তানের সঙ্গে বাবা-মাকে মিশতে হবে বন্ধুর মতো

যদি সংসারে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক থাকে, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক খোলামেলা হয়, তবে সেই সন্তান উদার মন ও উন্নত মানসিকতা নিয়েই বড় হয়ে উঠবে। লিখছেন জয়ন্ত দত্তযদি সংসারে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক থাকে, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক খোলামেলা হয়, তবে সেই সন্তান উদার মন ও উন্নত মানসিকতা নিয়েই বড় হয়ে উঠবে। লিখছেন জয়ন্ত দত্ত

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৫:০৫
Share:

প্রতীকী ছবি।

আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করছি, পড়ুয়াদের অনেকেই মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সেই শিশু যখন তার শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পা দেয়, তার এই প্রতিবন্ধকতা তাকে জেদি, উগ্র, অসহিষ্ণু করে তোলে। তাদের বাবা-মা প্রাথমিক ভাবে সেই রোগের কথা বুঝতে পারেন না। তাঁরাও অসহিষ্ণু হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলেন।

Advertisement

ফলে, সমস্যার জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের ছেলেমেয়েদের আচরণ সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তানদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন হয়। কারণ, তারা বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদের মতো সমস্ত আনন্দের ভাগীদার হতে পারে না, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে না। ফলে, তারা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই ধরনের সন্তানদের জন্য প্রথমেই মনোবিদের পরামর্শ ও চিকিৎসা করানো অত্যন্ত জরুরি।

এই ধরনের কিশোর-কিশোরীদের সবক্ষেত্রেই সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে। বাড়িতে অন্য সন্তানদের মতো তাদেরও সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সাধারণ বিদ্যালয়ে তারা ভর্তি হবে এবং বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে। শিক্ষক, শিক্ষিকারাও অবজ্ঞা না করে তাদের চাহিদার কথা শুনবেন এবং সহানুভূতির সঙ্গে তা মেটানোরও চেষ্টা করবেন। পাড়া-পড়শিরাও তাদের সঙ্গে সমান ভাবে মিশবেন। কখনও ভাবা যাবে না, এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা সমাজের অন্যদের থেকে আলাদা। বর্তমানে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে, বাবা-মাকে বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও করছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এই ধরনের কিশোর-কিশোরীদের উপর বিশেষ নজর দিচ্ছেন।

Advertisement

কিন্তু যে সুস্থ-স্বাভাবিক সন্তানেরা হঠাৎ মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে তার নেপথ্যে যে কারণগুলো থাকে সেগুলোকে প্রথমেই অভিভাবক বা শিক্ষক-শিক্ষিকারা বুঝতে পারেন না। ফলে, তার চিকিৎসা অনেক দেরিতে শুরু হয় বা অনেক ক্ষেত্রে না বোঝার কারণে চিকিৎসা হয়ও না। ফলস্বরূপ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাদের অনেকেই।

যদি কোনও পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে প্রতিদিন অশান্তি লেগে থাকে, বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে কিশোর মনে সাঙ্ঘাতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। সে তখন অসহায় বোধ করে। নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে ভীতির সঞ্চার হয়। আস্তে আস্তে সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই একটি সুস্থ-স্বাভাবিক সংসারে কিশোর-কিশোরীকে মানুষ করার গুরু দায়িত্ব বাবা-মায়ের। অব্যশই বাবা-মায়ের উচিত যে সন্তানকে তারা পৃথিবীতে এনেছেন তাকে সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা। আর এটা অবশ্যই তাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ।

বাবা-মায়ের উচিত, সন্তানের সীমাবদ্ধতা যাচাই করে তার থেকে প্রত্যাশা করা। নিজেদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টাই তাদের মানসিক রোগীতে পরিণত করে। এই জায়গা থেকে বাবা-মাকে সরে আসতেই হবে। তাই সন্তানের যে বিষয় ভাল লাগবে, তাকে সেই বিষয় নিয়ে পড়তেই উৎসাহ দেওয়া উচিত। পৃথিবীতে সব কাজেরই মূল্য সমান। সন্তান যে কাজে উৎসাহ দেখাবে সেই কাজ করতেই তাকে প্রেরণা জোগাতে হবে। তাতে অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে বলে বাবা-মা ভাবেন। কিন্তু নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের সেই উদ্ভট ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। শিক্ষকতা করতে গিয়ে লক্ষ করেছি, মাধ্যমিক পাশ করার পরে উচ্চ-মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া যেন একটা সামাজিক মর্যাদার স্বীকৃতি। আমরা বোঝানো সত্ত্বেও বাবা-মা সেই মর্যাদা ধরে রাখতে গিয়ে সন্তানদের জোর করে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে বাধ্য করেন। ফলস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানেরা বছর বছর অকৃতকার্য হয়ে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে। ফলে, আমাদের খুব সচেতন ভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের পারদর্শিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখাতে হবে।

বাবা-মাকে কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। কারণ, বর্তমানে এই ভোগবিলাসের সমাজে নানা রঙিন হাতছানি ছাত্রছাত্রীদের প্রলুব্ধ করে। তারা কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ বুঝতে পারে না। সেক্ষেত্রে তারা যদি সমস্ত কিছু তার বাবা-মায়ের কাছে নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় বলতে পারে এবং বাবা-মায়েরাও যদি ধৈর্য ধরে সেই কথা শোনেন এবং আন্তরিক ভাবে উপলব্ধি করে সন্তানদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন এবং সবসময় তাদের পাশে থাকেন তবেই সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যে এক সমন্বয়পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

সন্তানও পরবর্তী কালে কোনও কিছুই বাবা-মায়ের অজ্ঞাতে করার কথা ভাববে না। সন্তানকে সব কিছুতেই বাধা দেওয়া চলবে না। তাকে শুধুই অন্যের উদাহরণ দিয়ে ছোট করা যাবে না। তার যে কোনও কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারের অন্যদেরও জানাতে হবে তার সাফল্যের কথা। মনে রাখতে হবে, এই বিশ্বায়নের যুগে দিনে দিনে সমাজের নানা পরিবর্তন হচ্ছে, সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিভাবককেও মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে হবে। নিজেদের সেই পুরানো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সন্তানদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আবার সন্তানকে কিছুটা অনুশাসনেও রাখতে হবে।

সব সময় তাদের বোঝাতে হবে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। এবং কেন মন্দটি সে বর্জন করবে তারও ব্যাখ্যা সন্তানকে দিতে হবে। কেন একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়, ব্যবহার করলে কী কী অসুবিধায় পড়তে হতে পারে সমস্তটাই সুকুমারমতি কিশোর-কিশোরীদের পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। যে কোনও পরিস্থিতিকে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে শেখাতে হবে। কোনও কাজে ব্যর্থ হলে তাকে বিদ্রুপ না করে শেখাতে হবে ‘Failure is the pillar

of success’।

তবেই এই অস্থির সমাজের প্রতিটি বাধা অতিক্রম করে এবং বাবা-মায়ের আদর্শ অনুসরণ করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করতে পারবে বর্তমান সমাজের কিশোর-কিশোরীরা। যদি কোনও সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা না-ও থাকে, সন্তান পড়াশোনায় মধ্যমানের হয়, তবুও যদি সেই সংসারে বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে, সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক একদম খোলামেলা হয়, তবে সেই সন্তান উদার মন ও উন্নত মানসিকতা নিয়েই বড়

হয়ে উঠবে। (শেষ)

প্রধান শিক্ষক,

গোরাবাজার আইসিআই

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement