ভারতের শ্রমজীবীর ভরসা শিকার ও সংগ্রহ, লিখেছেন সমাজবিজ্ঞানী ইয়ান ব্রেম্যান। এ দেশের কয়েক কোটি শ্রমিক রোজ ‘কাজ শিকারে’ বেরোন, যে মজুরিতে যেমন কাজ পান, তা-ই করেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে কর্মক্ষেত্রে কর্মদিবসের সীমা নির্দিষ্ট করতে চেয়ে, যথাযথ বিশ্রাম ও মর্যাদা দাবি করে শিকাগো শহরের শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দেড় শতাব্দী— দেশবিদেশের শ্রমিক ইতিহাসে বড় বড় রদবদল ঘটেছে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে নানা বিতর্কে জড়িয়েছে বিশ্ব-রাজনীতি এবং বিশ্ব-অর্থনীতি। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতালব্ধ ভারতেও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কম তর্কবিতর্ক হয়নি। কিন্তু এখনও ভারতের মতো দেশে দশ জন শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ন’জনের ক্ষেত্রেই কাজের শর্তগুলি অত্যন্ত কঠিন। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের শারীরিক নিরাপত্তা, মজুরির হারও সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারে না। কৃষি থেকে ভাটি-খাদান, অথবা নির্মাণ ক্ষেত্রে বহু শ্রমিক কার্যত দাসত্ব করেন। অগ্রিম টাকা ঋণ নিয়ে, তা শোধ করতে অতি সামান্য মজুরিতে অতি দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করেন। এক দিকে শ্রমশক্তির জোরেই আজ ভারত এক বৃহৎ অর্থনীতি— দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের অবদানে আজ আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে বহু দেশের তুলনায় ভারত এগিয়ে রয়েছে। আর অন্য দিকে ভারতের রাজনীতি এখনও শ্রমিকের সুরক্ষা ও মর্যাদার প্রশ্নকে রেখে দিয়েছে শিল্প-সমৃদ্ধির বিপরীতে। ভাবটা এমন, যেন শিল্প ও শ্রম পরস্পর প্রতিপক্ষ।
পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতি বিরূপতাকেও প্রশ্রয় দেয় এই রাজনীতি। এবং এই সমাজ। আশ্রয়দাতা রাজ্যগুলির অর্থব্যবস্থায় অন্য রাজ্য বা অন্য দেশ থেকে আগত শ্রমিকদের কঠোর শ্রম, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ও নানাবিধ দক্ষতার যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা প্রমাণিত। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি তিক্ততা, এমনকি হিংস্রতা দেখা যাচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে। সেই সামাজিক অনুদারতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বিবিধ রকম রাজনীতি। বাজার ব্যবস্থাকে কুশলী রাখতে সেখানে শ্রমিকের যথাযথ অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হয়— এই কথাটি হয় সেই রাজনীতির অজ্ঞাত, অথবা কেবল মৌখিক বাচনেই সেই মস্তকবেদনা সীমাবদ্ধ। উন্নততর যন্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধির প্রয়োগের জন্য কাজের সংখ্যা কমছে সারা বিশ্বে, কিন্তু কর্মহীনতার জন্য সর্বপ্রথম পরিযায়ী শ্রমিকদেরই দায়ী করা হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ক্ষুদ্র স্বার্থে সেই অকারণ হিংসাকে উৎসাহ জোগাচ্ছে। বিশ্বে পুঁজির চলাচল উত্তরোত্তর সহজ হলেও ভারতের মতো দেশে যেন ক্রমশ কঠিন হয়েছে শ্রমিকের চলাচল, ব্যাহত হয়েছে শ্রমসম্পদের সর্বাধিক লাভজনক নিয়োগ। জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের পাঁচিল তুলে শ্রমের বিশ্বায়নকে রুখে দেওয়া বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের অন্যতম কারণ। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষার সুবিবেচিত নীতি যে শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের রাজনীতির পথ সুগম করতে পারে, সে সত্যটি যেন অন্তরালে চলে গিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে বিপন্নতা আরও বাড়িয়েছে কর্মহীনতা। একদা ভারতে বছরে দুই কোটি কাজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিল্লিতে ক্ষমতারোহণের আট বছর অতিক্রম করে তিনি নিজেও হয়তো আজ তা বিস্মৃত হয়েছেন।
সুতরাং ভারতে শ্রমিক-সুরক্ষা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কথার খেলামাত্র। কিছু আইন, প্রকল্প তৈরি হয়, কিন্তু কাজের বেলা শ্রমিককে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। নিয়োগকর্তা, ঠিকাদার বা সরকার, শ্রমিকের সুরক্ষার দায় যে কার, তা অস্পষ্ট থেকে যায়। ২০২০ সালের এপ্রিম-মে মাসের ‘লং মার্চ’ বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভারতের নাগরিক হয়েও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ কতটা অসহায়। ওই ঘটনার পর বিশ্বজোড়া ধিক্কারে সরকারি সহায়তার প্রকল্পগুলি কিছু গতি পেয়েছিল, এইটুকুই লাভ। ই-শ্রম পোর্টালে সাতাশ কোটি শ্রমিক নথিভুক্ত হয়েছেন, ভিনরাজ্যে রেশন কার্ড গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি শ্রম ও শ্রমিকের মৌলিক সঙ্কট কাটার কোনও লক্ষণ দেখা যায়? শ্রমিকের স্বার্থের সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির সম্পর্কটি রাজনীতি বুঝছে কি? বিশেষত মহিলাদের পরিস্থিতি পীড়াদায়ক। মেয়েদের এক বড় অংশ শিক্ষিত হয়েও সুরক্ষিত শ্রমের বাজারে সংযুক্ত হতে পারেন না। সেই পরিসর সৃষ্টি করতে না পারলে ভারতের এই বিপুল মানবসম্পদ শেষ অবধি অব্যবহৃত, অসন্তুষ্ট এবং বিপন্ন থেকে যাবে। সেটা এক সমূহ ক্ষতি। শুধু শ্রমশক্তির ক্ষতি নয়, সমগ্র অর্থব্যবস্থার ক্ষতি।