Taj Mahal

সর্বগ্রাসী

সমস্ত ইতিহাসের উপর নিজের একশৈলিক দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দেশের বহুত্বপূর্ণ অতীতকে মুছে দেওয়ার উদ্যোগটি করা সহজতর হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২২ ০৫:২০
Share:

ফাইল চিত্র।

উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা রজনীশ সিংহের মনে হয়েছে, তাজ মহলের বাইশটি বন্ধ ঘরেই লুকানো আছে তার ‘আসল ইতিহাস’। তা কেমন? তাঁর মতে, ওই বন্ধ ঘরগুলো খুললেই নাকি বেরিয়ে আসবে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, আর তাতেই বোঝা যাবে ‘তেজো মহালয়’ (‘তাজ মহল’ নয়) আদতে ছিল শিব মন্দির। ইলাহাবাদ হাই কোর্টে আপাতত এই দাবি খারিজ হয়ে গেলেও তাকে স্রেফ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাতে এক ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিতকে অগ্রাহ্য করা হয়। ইতিহাস বলবে, ১৯৮৯ সাল থেকেই ধারাবাহিক ভাবে এই মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গিয়েছে নানা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এখন সেই বক্তব্য আরও জোরদার হচ্ছে, এবং তার সঙ্গে কখনও শোনা যাচ্ছে কুতুব মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ ঘোষণা করার দাবি, কখনও দেখা যাচ্ছে কাশ্মীরের পুরাতাত্ত্বিক সৌধ মার্তণ্ড সূর্য মন্দিরে ঢুকে পড়ে পূজার্চনার দৃশ্য। অযোধ্যা সূচনামাত্র, কাশী-মথুরা বাকি আছে— এই স্লোগানের যাথার্থ্য এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বোঝা যায়, যে সব শক্তি এত দিন সমাজে প্রান্তিক হিসাবে পরিগণিত হত, তারা ক্রমশ এক সূত্রে গ্রন্থিত হচ্ছে। আশঙ্কা এখানেই।

Advertisement

এর পিছনে সুস্পষ্ট রাজনীতি আছে— সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি। তা বলে, সমস্ত ইতিহাসের উপর নিজের একশৈলিক দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দেশের বহুত্বপূর্ণ অতীতকে মুছে দেওয়ার উদ্যোগটি করা সহজতর হয়। আর শাসক দলের স্নেহাশীর্বাদ যদি মাথার উপর থাকে, তা হলে এই আখ্যানকে জোটবদ্ধ ও জোরদার করার কাজটিও তুলনায় বাধাহীন ভাবে হতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে এখন ঠিক তা-ই হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির এক মন্তব্যে এই আশঙ্কা গভীরতর হয়েছে। পার্টিকর্মীদের প্রতি তাঁর বার্তা: কেউ যদি মসজিদ নিয়ে নিতে চায় তো নিক, কিন্তু তা যেন কোনও সংঘর্ষের কারণ না হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সংখ্যাগুরু যদি বাহুবলের পথে হাঁটে, তা হলে প্রতিরোধের শক্তি প্রয়োগেরও প্রয়োজন নেই, নিজের অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই যথেষ্ট। মুফতির কথাটিকে আক্ষরিক অর্থে না দেখে তাতে প্রকাশিত অনুভূতিটির দিকে নজর দেওয়া ভাল। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাজনীতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর থেকে একটু একটু করে তার অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে এতটাই কোণঠাসা করে ফেলেছে যে, আত্মরক্ষার্থে তাদের নিজস্ব ও স্বাভাবিক পরিসরগুলির স্বত্বত্যাগ করার কথা ভাবতে হচ্ছে— এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পক্ষে অতি লজ্জার।

এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করতেই হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞান হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপগুলিকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে পরিণত করা। ঐতিহাসিক সৌধের দাবি নিয়ে যখন টানাটানি চলে, অথবা কেউ সেখানে সরাসরি তাতে ঢুকে পড়ে অধিকার কায়েম করতে চান, তখন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সরকারের অগাধ নীরবতাকে হিরণ্ময় বলে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। নাগপুরের একশৈলিক ভারতের ধারণা আসলে তেমনই— সেখানে স্বর থাকবে কেবল সংখ্যাগুরুর, অবশিষ্ট সব ‘অপর’ হবে অনস্তিত্ব। ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, পোশাক থেকে ধর্ম— সবেতেই সেই ‘একীকরণ’-এর ছাপ। এটা সুসভ্য গণতন্ত্রের দস্তুর নয়। ‘ভারত’-এর কল্পনাটি এই রকম ছিল না। সেই বহুত্ববাদী ভারতকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন নিতেই হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement