Partition

Partition of India: প্রকৃত গরল

তাহা স্বাধীনতার ইতিহাসের সহিত ওতপ্রোত হইয়া আছে। ছাত্রছাত্রীরা সেই ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হইবে, ইহা কেবল কাম্য নহে, জরুরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২১ ০৮:২৩
Share:

ফাইল চিত্র।

মেরুকরণ প্রকল্পের নবপর্যায় নির্ঘণ্ট অনুসারেই চলিতেছে। বোধন করিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। ১৪ অগস্ট দিনটিকে দেশভাগের বিভীষিকার স্মারক দিবস হিসাবে উদ্‌যাপনের ডাক দিয়াছিলেন তিনি। তাঁহার সহকর্মী ও সহমর্মীরা নিশ্চয়ই তাঁহার অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হইয়াছেন। যেমন, রাজ্যসভায় উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সাংসদ হরনাথ সিংহ যাদব প্রধানমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণে এক পা অগ্রবর্তী হইয়া প্রস্তাব করিয়াছেন, দেশভাগের কাহিনিকে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হইবে। তাঁহার মতে, কী কারণে দেশ ভাগ হইয়াছিল, কাহারা তাহার জন্য দায়ী ছিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ কী ধরনের অত্যাচারের শিকার হইয়া ভারতে চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন— এই সকল তথ্য ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে যথেষ্ট পরিমাণে থাকা উচিত। এই প্রস্তাব যদি অতঃপর বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের প্রবল উদ্যোগে প্রতিধ্বনিত হইতে শুরু করে, সেই ‘জাতীয়তাবাদী’ দাবিকে সম্মান জানাইয়া পাঠ্যক্রম সংশোধনের উদ্যোগও যদি শুরু হইয়া যায়, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে সংশোধিত ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক তৈয়ারি হইয়া যায়, বিস্ময়ের কিছুমাত্র কারণ নাই।

Advertisement

দেশভাগ অবশ্যই আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাহা স্বাধীনতার ইতিহাসের সহিত ওতপ্রোত হইয়া আছে। ছাত্রছাত্রীরা সেই ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হইবে, ইহা কেবল কাম্য নহে, জরুরি। সেই উদ্দেশ্যে পাঠ্যক্রম সংশোধনেরও নিশ্চয়ই যুক্তি থাকিতে পারে, যেমন সংশোধনের যুক্তি থাকিতে পারে অন্য নানা ক্ষেত্রেও। কোনও ইতিহাসই অপরিবর্তনীয় শিলালিপি নহে। কিন্তু বর্তমান শাসকরা যে সংশোধনের কথা বলিতেছেন তাহার উদ্দেশ্য কী? দেশভাগের বিভীষিকা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যন্ত্রণা ঐতিহাসিক সত্য, দেশভাগকে অভাবিত হইতে এক সময় সম্ভাব্য এবং অবশেষে অনিবার্য করিয়া তুলিবার পিছনে সঙ্কীর্ণ ও কুটিল রাজনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার কি সেই ইতিহাসের যথাযথ বিশ্লেষণ চাহে? তথ্যনিষ্ঠ, পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণ? যেমন, দেশভাগের পশ্চাদ্‌বর্তী রাজনীতিতে মুসলিম লীগের পাশাপাশি হিন্দু মহাসভার ভূমিকা ও অবদান কী ছিল, দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রস্তাবনায় বিনায়ক দামোদর সাভারকর যে মহম্মদ আলি জিন্নার পূর্বসূরি— এই ঐতিহাসিক সত্যগুলি শিক্ষার্থীরা সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে পড়িবে কি?

উত্তর লইয়া কোনও সন্দেহের অবকাশ বর্তমান শাসকরা রাখেন নাই। বছরের পর বছর, বিশেষত নির্বাচনী মরসুমে, তাঁহাদের প্রচার এবং কীর্তিকলাপ বলিয়া দেয় যে, তাঁহাদের লক্ষ্য বিশ্লেষণ নহে, মেরুকরণ। যে মেরুকরণের ফলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুকে অপরাধী প্রতিপন্ন করিয়া এবং সংখ্যাগুরুর ভোট সংগ্রহ করা যাইবে। এই দ্বিমেরু বিভাজনকেই এখন নূতন করিয়া উত্তেজিত করা আবশ্যক হইয়াছে। অতএব দেশভাগের বিভীষিকা স্মরণের আহ্বান, কী ধরনের অত্যাচারের তাড়নায় ও আতঙ্কে শরণার্থীরা চলিয়া ‘আসিয়াছিলেন’ তাহার একতরফা বিবরণ ছাত্রছাত্রীদের শিখাইবার প্রস্তাব। ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজনের মানসিকতা সৃষ্টির এই উদ্দেশ্যটির দুইটি মাত্রা আছে: দীর্ঘমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে, সংশোধিত পাঠ্যক্রম ভাবী নাগরিকদের মনে বিভাজন ও বিদ্বেষের বীজগুলি যথেষ্ট পরিমাণে বপন করিলে রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ চূর্ণ করিয়া সঙ্ঘের কাঙ্ক্ষিত ভারত নির্মাণের ভিত জোরদার হইতে পারে। কিন্তু তাহা ভবিষ্যতের কথা। আশু তাগিদটি উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে ফসল তুলিবার। মেরুকরণের বীজ উচ্চফলনশীল হইবে, এই হিসাব কষিয়াই দেশভাগের বিভীষিকা স্মরণ এবং পঠনপাঠনের উদ্যোগ। এমন হিসাব কষিবার দুর্বুদ্ধি দেশ শাসন করিতেছে— ইহাই কি প্রকৃত বিভীষিকা নহে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement