coronavirus

পুরাতন ব্যাধি

জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘টিকানীতি’ প্রকাশ করিয়াছিল, বর্তমান বণ্টন-অসাম্যের যুক্তি হিসাবে তাহাকেই ব্যবহার করা হইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২১ ০৫:০৯
Share:

আদালতে হলফনামা পেশ করিয়া যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তাহা রক্ষা করিতে পারিল না। জুলাই মাসের মধ্যে দেশে যত কোভিড-ভ্যাকসিন সরবরাহ করিবার কথা ছিল, বাস্তবে হইয়াছে তাহার তুলনায় প্রায় দুই কোটি ডোজ় কম। এই ঘটনাকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে— বরং, সরকার যদি প্রতিশ্রুতিমাফিক টিকার জোগান দিতে পারিত, তাহাই বিস্ময়ের কারণ হইত। টিকার প্রশ্নে এই সরকার কেবলই ফেল করিয়াছে— ফলে আশঙ্কা জাগিতেছে যে, ডিসেম্বরের মধ্যে আঠারো-ঊর্ধ্ব সকল নাগরিককে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যটিও পূরণ হইবে না। যদি আশঙ্কাটি সত্য হয়, তাহার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ব্যতীত অন্য কাহাকে দোষ দিবার নাই। দেশে কত টিকা প্রয়োজন, কত উৎপাদন হইতেছে এবং কত ঘাটতি থাকিতেছে, এই সামান্য হিসাবটি গত সাত মাসে কষিয়া উঠিতে পারে নাই সরকার। দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কী প্রয়োজন; তাহার পরও যে ঘাটতি থাকে, আন্তর্জাতিক বাজার হইতে তাহার সংস্থান করিবার জন্যই বা কী পদক্ষেপ করিতে হইবে— সেই বিষয়ে কেন্দ্রের চিন্তাভাবনা কী, দেশবাসী জানিতে পারে নাই। বাস্তব পরিস্থিতি দেখিয়া অনুমান করা চলে যে, বিশেষ চিন্তাভাবনা ছিলও না। আর পাঁচটি ক্ষেত্রে যেমন অর্ধসত্য ও ডাহা মিথ্যার মিশেলে কাজ চলিয়াছে, আশঙ্কা হয় যে, সরকারের আশা ছিল কোভিড-টিকার ক্ষেত্রেও সেই দাওয়াই-ই যথেষ্ট হইবে। ‘বিশ্বগুরু’ হইয়া উঠিবার মিথ্যা আস্ফালন আর যথার্থ প্রস্তুতির মধ্যে যে গভীর ব্যবধান, নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে ভারত আপাতত সেই খাদেই পড়িয়াছে। উঠিতে পারিবে, এখনও সেই আশা ক্ষীণ।

Advertisement

অনৃতভাষণ ও ফাঁপা অহঙ্কারের ব্যাধিটি যেমন, তেমনই সকল প্রশ্নকেই ক্ষুদ্র রাজনীতির চালুনিতে ছাঁকিয়া লইবার অভ্যাসটিও ভারতকে বিপাকে ফেলিয়াছে। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যত টিকা বণ্টিত হইয়াছে, তাহাতেও বিস্তর গোলমাল। গুজরাতে আঠারো বৎসরের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ টিকা পাইয়াছেন— পশ্চিমবঙ্গে সেই টিকাপ্রাপ্তির হার মাত্র ৩০ শতাংশ। কোভিড টিকাকরণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি নেতৃত্ব যে ভঙ্গিতে মাঝেমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গকে আক্রমণ করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ হইতে পারে যে, টিকা বণ্টনে এই অসাম্য রাজনৈতিক অস্ত্র তৈরি করিবারই সজ্ঞান প্রচেষ্টা নহে তো? এই প্রশ্নটি উঠিত না, যদি কেন্দ্রীয় সরকার টিকা বণ্টনের প্রশ্নটিতে স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ করিত। হায়, সরকারের স্বচ্ছতা শুধু বৎসরের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু দিনে রাস্তায় ছড়াইয়া দেওয়া পাতা সাফ করিবার প্রতীকী অভিযানেই সীমাবদ্ধ থাকিয়া গেল।

জুন মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে ‘টিকানীতি’ প্রকাশ করিয়াছিল, বর্তমান বণ্টন-অসাম্যের যুক্তি হিসাবে তাহাকেই ব্যবহার করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে যে, শুধু রাজ্যের জনসংখ্যা নহে, টিকার অপচয়-সহ আরও অনেক বিষয়ের উপর রাজ্যের টিকাপ্রাপ্তি নির্ভর করে। প্রশ্ন হইল, যে নীতি অনুসরণের ফলে দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে টিকা বণ্টনের বিপুল অসাম্য দেখা দিতেছে— কোনও কোনও রাজ্যের সিংহভাগ মানুষের নিকট টিকা পৌঁছাইতেছেই না— তাহাকে কি কোনও মতেই ন্যায্য নীতি বলা চলে? এত দিনেও কেন সরকার তাহার টিকানীতি বিষয়ে রাজ্যগুলির সহিত— বা বৃহত্তর ভাবে নাগরিক সমাজের সহিত— আলোচনা করিল না? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে এই সরকারের আগ্রহ নাই, এত দিনে তাহা সংশয়াতীত। কিন্তু, যেখানে আক্ষরিক অর্থেই নাগরিকের মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন, সেখানেও যদি দেশের শাসকরা ক্ষুদ্র রাজনীতি, পর্বতপ্রমাণ অহং এবং সর্বগ্রাসী অনৃতভাষণের প্রবণতা ত্যাগ না করিতে পারেন, শাসক হিসাবে তাঁহাদের বৈধতা কি প্রশ্নের মুখে পড়ে না?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement