প্রতীকী চিত্র।
রাহুল গাঁধী বলিয়াছেন, দেশদ্রোহ। রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলিয়াছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলিয়াছেন, আইনের শাসন যিনি চালাইতে পারেন না তাঁহার দেশ শাসন করিবার যোগ্যতা নাই। তিরটি কাহার দিকে, বলিয়া দিতে হইবে না। পেগাসাস রীতিমতো ঝড় তুলিয়াছে দেশের বিরোধী মহলে। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নীরবতা দিয়া এবং অন্য মন্ত্রী-নেতারা প্রতি-আক্রমণ শাণাইয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনিতে পারিবেন কি? ইত্যবসরে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী একটি জরুরি মন্তব্য করিয়াছেন। বলিয়াছেন, “মোদীজি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলিতেছেন, আর যাহা বাস্তবে হইতেছে তাহার নাম সার্ভেল্যান্স ইন্ডিয়া।” গুরুতর কথা বটে। যুক্তি বলিতেছে, এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ অতি নিকট— নাগরিক সাধারণ বুদ্ধিতে যতটুকু বুঝিতেছেন, তাহার অপেক্ষা বহুগুণ বেশি। একের পর এক বিরোধী নেতার ফোনে যখন আড়ি পাতার প্রমাণ মিলিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাবদিহি করিতেই হইবে। কিন্তু রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছাড়াও এই নজরদারির পিছনে আরও একটি নিয়ন্ত্রণাতীত ক্রিয়া যুক্ত হইয়াছে— ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। টেলিকমিউনিকেশনই হউক, আর সোশ্যাল মিডিয়াই হউক, একটি সাধারণ সূত্রে নাগরিক এখন রাষ্ট্রের এক অভূতপূর্ব গোপন জালে বাঁধা পড়িয়াছেন, অজানতে, নিরাময়বিহীন ভাবে। পেগাসাস বিষয়টির বৃহত্তর গুরুত্ব এইখানেই। অস্বীকার করা যায় না যে, এখনই প্রথম নহে, পূর্বেও সরকার কর্তৃক ব্যক্তি-অধিকার ভঙ্গ করিয়া নজরদারি চলিত, অন্তত ক্ষেত্রবিশেষে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই সরকারি ঐতিহ্য যে লাগামছাড়া বন্দোবস্তে পরিণত হইয়াছে, তাহার পিছনে এই ডিজিটাল সক্রিয়তা বিশেষ জোরদার। বস্তুত, নাগরিকদের ব্যক্তিগত— এবং সেই কারণেই গোপনীয়— তথ্য রাষ্ট্র কী ভাবে হস্তগত করিবার কৌশল খোঁজে, গত সাত বৎসর ধরিয়াই তাহার নমুনা মিলিতেছে। কিন্তু, সেই পরিপ্রেক্ষিতেও পেগাসাস-কাণ্ড বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।
বাস্তবিক, পেগাসাসই প্রথম দেখাইল, জাতীয় স্বার্থে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত অতি-আধুনিক স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি দিয়া সম্পূর্ণত অনৈতিক ভাবে সাধারণ ব্যক্তিনাগরিকের জীবনেও কী ভাবে নজরদারি চলিতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপর যাঁহারা নজরদারি চালাইতেছেন, সত্যকথনের সময় উপস্থিত হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই আত্মপক্ষ সমর্থন করিবেন এই বলিয়া যে, ওই ব্যক্তিরা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক বলিয়াই নজরদারির প্রয়োজন হইয়াছিল। অর্থাৎ, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তকমার একটি বিস্ফোরিত ব্যক্তার্থ এই যুক্তির মধ্যে নিহিত থাকিবে। যাঁহাদের উপর নজর রাখা হইয়াছে, তাঁহাদের নামই বলিয়া দিতেছে, বর্তমান সরকার তাহার বিরোধী মাত্রকেই জাতীয় স্বার্থের শত্রু বলিয়া প্রমাণ করিতে চাহে।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর পূর্ণ হইবার প্রহরে ভারত কি তবে বুঝিতেছে, ইতিমধ্যে সে অজ্ঞাতে গণতান্ত্রিক রূপটি হারাইয়া বসিয়াছে! গণতন্ত্রের অর্থ তো কেবল ভোট দিবার অনুষ্ঠান নহে, সংবিধানে গণতন্ত্রের অর্থ— ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরও বটে। সেই পরিসর রক্ষা করিবার প্রয়োজনের কথাও নির্দেশিত আছে সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায়। সাম্প্রতিক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সহিত এই ধারার বিরোধাভাস ঘটায় ইতিমধ্যে সেই আইনেরও সংশোধনের দাবি উঠিয়াছে। সোজা কথা, ‘জ়িরো ডিটেকটেবল’ বা অপ্রকাশ্য/অগোচর পদ্ধতিতে সমস্ত জনসমাজকে যদি এই ভাবে সাইবার সার্ভেল্যান্স-এর নীচে টানিয়া আনা হয়, সে ক্ষেত্রে আর কোনও দিন কোনও নাগরিকই এ দেশে ‘স্বাধীন’ থাকিবেন না। ভারতীয় মাত্রেই হইবেন রাষ্ট্রাধীন, কিংবা রাষ্ট্রের বন্দি। ডিজিটাল ইন্ডিয়া-র কি তবে তাহাই ভবিষ্যৎ?