বরফ অনেকখানি জমে গেলে তা গলা সহজ নয়। তবু, হিমগলনের ইঙ্গিত সব সময়েই আশাবাহী। ভারত-মলদ্বীপ সম্পর্কের গতিপথ দেখে যেন তেমন ইঙ্গিতই মিলছে। মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ়জ়ু ভারতে তাঁর প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরে এসে শুধু ভারতীয় পর্যটকদের তাঁর দেশে আসার জন্য উৎসাহিত করলেন না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও আমন্ত্রণ দিলেন মালে আসার। এমনকি দিল্লিকে মলদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসাবে স্বীকার করে তিনি সাফ জানিয়েছেন, তাঁর সরকার ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে দেবে না। অথচ, দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের সূত্রপাত যখন গত বছরের শেষের দিকে ভারতবান্ধব ইব্রাহিম মহম্মদ সোলি-কে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন বেজিং-মনোভাবাপন্ন মুইজ়জ়ু, ভারত-বিরোধী প্রচারই ছিল তাঁর বাহন। শুধু তা-ই নয়, সামরিক ও মানবিক সহায়তার জন্য ২০১২ সাল থেকে সে দেশে মোতায়েন ভারতীয় সৈন্যদের সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রচারে, যার জেরে এ বছর সেনাদের বদলে প্রযুক্তিগত কর্মীদের সে দেশে পাঠিয়েছে দিল্লি। পূর্বে ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর প্রাক্তনীরা যেখানে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ককে মান্যতা দিতে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরে এসেছিলেন দিল্লিতে, মুইজ়জ়ু কিন্তু তা করেননি। বরং গত জানুয়ারিতে চিনে গিয়ে পরিকাঠামো এবং পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। তিক্ততা আরও বাড়ে যখন প্রধানমন্ত্রী মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরের ছবি নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে মুইজ়জ়ু সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এর পরেই সমাজমাধ্যমে ‘মলদ্বীপ বয়কট’-এর ডাক তোলেন ভারতীয় পর্যটকদের একটি বড় অংশ। মলদ্বীপের অর্থনীতির অন্যতম ভিত পর্যটন। এ-হেন ঘটনার জেরে দ্বীপরাষ্ট্রটির থেকে ভারতীয় পর্যটকেরা মুখ ফেরানোয় সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে মলদ্বীপকে।
এ দিকে ক্ষমতায় আসার পরে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হয়নি মুইজ়জ়ু সরকার। বরং, ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ এবং ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার জেরে গভীরতর আর্থিক সঙ্কটের দিকেই এগোচ্ছে তাঁর দেশ। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অংশ হওয়ায় এমনিতেই বেজিং-এর কাছে প্রচুর ঋণ রয়েছে মালে-র। বেজিং তাকে ১৩ কোটি আমেরিকান ডলার এবং সুদ ফেরতের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের অতিরিক্ত সময় দিয়েছে। বেজিং-এর উপরে অত্যধিক নির্ভরতা যে কোনও দেশকে কী ভাবে চিনের আর্থিক ফাঁদে ফেলতে পারে, শ্রীলঙ্কার সূত্রে তা বিলক্ষণ জানেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। কোন উদ্বেগের জেরে তিনি ভারতনীতি বদল করছেন, তার ইশারা মেলে এখানে।
প্রত্যাশিত ভাবেই, মলদ্বীপের এই সঙ্কটে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিয়ে ত্রাণদাতার ভূমিকা পালন করেছে ভারত। আপাতত মালে-র সঙ্গে সমীকরণ কিছুটা ঠিকঠাক হলেও দিল্লি ভোলেনি যে মালে ও বেজিং-এর সম্পর্ক এখনও ঘনিষ্ঠ। ভারত মহাসাগরে তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জেরে ও এই অঞ্চলে ভারতের উপরে চাপ বজায় রাখতে মলদ্বীপকে কোনও দিনই হাতছাড়া করতে চাইবে না বেজিং। বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক সরকার বদলের জেরে ভারতকে অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই হবে।