ভাষা রহস্যময়ী। ভাষার ছত্রে-ছত্রে এবং পরতে-পরতে কত যে রূপক ছড়িয়ে থাকে! রসিকজনের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল, জনারণ্যেও তো কত কথাই অহরহ রূপকার্থে বলা হচ্ছে! বস্তুত, বক্তার কোন কথাটা কখন তার আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে আর কখন তার নিহিত রূপকটিকে ধরতে হবে, শ্রোতা সচরাচর সচেতন ভাবে তা ঠিক করেন না, তাঁর সামাজিক অভ্যাসই তাঁকে সেটা জানিয়ে দেয়। এমনটা না হলে সংসারে বেঁচে থাকাই কঠিন হত। মা ছেলেকে বললেন ‘না খেয়ে বেরোস না বাবা, আমার মাথা খা’, আর ছেলে টপ করে তাঁর মাথাটি খেয়ে ফেলল, তা তো আর হয় না! কিংবা, ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে কেউ যদি পথে আলো না ধরে, তা হলে অমনি ফস করে দেশলাই ধরিয়ে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে রাস্তার মধ্যেই একলা-একলা জ্বলে পুড়ে যেতে হবে— রবীন্দ্রনাথ ঠিক এমন বিধান দেননি। কথার রূপকার্থ আর আক্ষরিক অর্থ মিশিয়ে ফেললে কী বিষম বিপুল ঝঞ্ঝাট হতে পারে, সুকুমার রায়ের অমৃতভান্ডারে তার— কেবল ‘শব্দকল্পদ্রুম’ নয়— আরও নানা নিদর্শন মিলবে। তবে এ সবই হল কৌতুকের কথা। বিপদ ঘটে তখন, যখন ভাষার বিবিধার্থবিনিশ্চয়ের ব্যাপারটা সামাজিক বা রাজনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, জড়িয়ে যায় হিংস্রতার সঙ্গে, যে হিংস্রতা প্রথমত কথার, কিন্তু অতি সহজেই যা পর্যবসিত হতে পারে আচরণের হিংস্রতায়, এমনকি শারীরিক আক্রমণে— কিন্তু তেমন প্রত্যক্ষ আক্রমণ অবধি না পৌঁছলেও উচ্চারণ বা আচরণের হিংস্রতা কিছু কম ভয়ঙ্কর নয়।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে তার একাধিক নিদর্শন দেখা গেল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ভয়ানক রকমের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করলেন এক ‘ছাত্রনেতা’ এবং তার পরে তিনি জানালেন, এ নাকি তাঁর অপমানিত সত্তার প্রতিবাদ, যে প্রতিবাদের ভাষা তিনি সংগ্রহ করেছেন প্রথা-বিরোধী সাহিত্যের পরিসর থেকে— সামাজিক শিষ্টাশিষ্ট বিচারের স্বীকৃত সীমারেখাকে লঙ্ঘন করেই সেই প্রতিবাদ জানাতে হয়। অর্থাৎ, তাঁর অশালীন শব্দগুলির আক্ষরিক অর্থ ধরলে চলবে না, সেগুলি তিনি রূপকার্থেই বলেছেন। আবার, এই ঘটনার অল্পকাল পরেই আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আর এক ছাত্রনেতা প্রতিপক্ষের নাম করে তাঁদের চার দিক থেকে ঘিরে ধরে ছুটিয়ে মারার এবং ঘৃণা ও ক্ষোভের আগুনে পুড়িয়ে মারার আহ্বান জানালেন, তা শুনে প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করলে তিনি জানালেন যে, তিনি ‘রূপক’ হিসাবেই ছুটিয়ে মারা বা পুড়িয়ে মারার কথা বলেছেন। তাঁর সতীর্থরাও এই প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন যে, ‘কালো হাত ভেঙে দেওয়া’ ইত্যাদি স্লোগান যখন দেওয়া হয়, তখন তো আর সত্যই হাত ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয় না!
বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক বক্তৃতায় ভেঙে দেওয়া, গুঁড়িয়ে দেওয়া, মেরে দেওয়া ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করা আর উপাচার্য বা শিক্ষকের ঘরে চড়াও হয়ে তাঁকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করা ও হুমকি দেওয়া এক হতে পারে না। কিন্তু সেটা বলার পরেও একটি অতি বড় প্রশ্ন থেকে যায়। যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে যে পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে ভাষার ধর্ম কী ভাবে জড়িয়ে যায়, সেই প্রশ্নটি জটিল। সমাজ-রাজনীতি যখন স্বভাবত হিংস্র, তখন অনেক আক্রমণাত্মক শব্দ বা বাক্য রূপকার্থে প্রয়োগ করলেও কি তাকে আর সেই অর্থে বেঁধে রাখা সম্ভব? হিংসাধর্মী সমাজে শ্রোতা উগ্রভাষার রূপকার্থকে না বুঝে আক্ষরিক অর্থে তাকে গ্রহণ করবেন, এমন আশঙ্কা তো কম নয়। আরও বড় আশঙ্কা, রেষারেষির ফসল কুড়োনোর তাগিদে এক পক্ষ অন্য পক্ষের কথাকে তার ভুল অর্থে ব্যাখ্যা করবেন এবং সেই ব্যাখ্যাই সমাজের কাছে চালিয়ে দেবেন। আবার, উল্টো দিকে, ‘রূপক’-এর দোহাই দিয়ে সমস্ত রকমের দুরাচারের সওদাগরেরা হিংস্র ভাষাকে তাদের অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগাতে পারে, অচিরেই হয়তো তারা যুক্তি দেবে: ‘গোলি মারো সালোঁ কো’, এই মারণ-স্লোগানও রূপকার্থেই নিক্ষিপ্ত। এমন অপূর্ব পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ‘পবিত্র’ ঘৃণা এবং ‘ক্রোধ’-এর পুরনো লব্জগুলিকে নিয়েও এ বার নতুন করে ভাবা দরকার। ‘ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ না বলেও তীব্র প্রতিবাদ করা যায় বইকি! যা দিনকাল পড়েছে, রবীন্দ্রনাথ থাকলে আজ নিশ্চয়ই ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো’ লেখার আগে দু’বার ভাবতেন!