গল্পের চরিত্র নাসিরুদ্দিন মোল্লা মাংস চুরি ধরতে বিড়ালকে ওজন করে প্রশ্ন করেছিলেন, এটা মাংস হলে বিড়াল কোথায়? ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ প্রকল্পে ভূমিহীন চাষি অথবা ক্ষুদ্র উদ্যোগপতি নিখরচায় সরকারি খামারের জমি পাবেন চাষ করতে, সরকারের এই ঘোষণা শুনে রাজ্যবাসীও তেমনই প্রশ্ন করতে পারেন, সরকারি খামারে ভূমিহীন চাষি চাষ করলে উন্নত বীজ তৈরি হবে কোথায়? প্রকল্পের রূপকাররা হয়তো প্রশ্ন করবেন, বাজারে যদি উন্নতমানের বীজ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে, তা হলে সরকারের বীজ উৎপাদনের প্রয়োজন কী? স্বাধীনতার পরে প্রতিটি ব্লকে বিস্তৃত এলাকা নিয়ে সরকারি খামার তৈরি হয়েছিল বীজ তৈরির উদ্দেশ্যে। সরকারি খামারে প্রস্তুত নতুন নতুন প্রজাতির উচ্চফলনশীল বীজ দিয়েই ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে ‘সবুজ বিপ্লব’ সম্ভব হয়েছিল। তখন এর প্রয়োজনও ছিল তীব্র, কারণ ষাটের দশকেও বেসরকারি ক্ষেত্রে বীজ উৎপাদন হত অতি সামান্য, ভারতের অধিকাংশ চাষি নিজেদের তৈরি বীজে চাষ করতেন, অল্প কিছু চাষি নির্ভর করতেন সরকারি বীজ-খামারের উপর। ক্রমে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি বীজ উৎপাদন ও বিপণনে এগিয়ে এসেছে, ফলে বীজের জন্য সরকারি খামারের উপর চাষির নির্ভরতা কমে এসেছে। তা হলে সরকারি খামারের জমি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে ক্ষতি কী? এও ঠিক যে, গোড়া থেকেই সরকারি বীজ-খামারের কাজে প্রশাসনিক শৃঙ্খলার অভাব ছিল— যে কোনও সরকারি উদ্যোগের মতো, এ ক্ষেত্রেও শিথিলতা, দুর্নীতি ও অপচয় প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করেছে। তা হলে পুরনো ‘মডেল’ বয়ে চলাই বা কেন?
সরকারি নিয়ম প্রয়োজনে নমনীয় হবে, সেটাই কাম্য। প্রশ্ন একটাই— নতুন পরিকল্পনা পুরনো চাহিদা মেটাতে পারবে তো? এমন ব্যর্থতার নিদর্শন ইতিমধ্যেই দেখেছে এ রাজ্য— প্রতিটি ব্লকে সরকারি খামারের জমিতে সরকারি খরচে নির্মিত কৃষক মান্ডিগুলির অধিকাংশ শূন্য পড়ে রয়েছে। গ্রাম-মফস্সলের বাজার এলাকা থেকে এগুলির অবস্থান দূরে, দৈনন্দিন কেনাবেচার উপযুক্ত নয়। তাই প্রতি ব্লকে সরকারি মান্ডির চাহিদা থাকলেও, বীজ-খামারের জমিতে মান্ডিনির্মাণ ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা। ভূমিহীন চাষির জমি দরকার, সরকারের হাতে জমি রয়েছে— কিন্তু বারোটি জেলায় ষোলোটি বীজ-খামারের আড়াই হাজার একর জমি কাজে লাগানোর মতো যথেষ্ট ভূমিহীন চাষি বা ক্ষুদ্র উদ্যোগী কি আশেপাশের এলাকাগুলিতে আছেন? তাঁদের বকলমে যদি বা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ প্রকল্পে অংশ নেয়, সেগুলি কি বাংলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির জন্য সুলভ ও উন্নত উপকরণের উৎপাদন ও প্রসারের উদ্দেশ্যে কাজ করবে?
বাংলার অন্তত অর্ধেক চাষি এখনও বীজ কিনতে পারেন না, ঘরের বীজে চাষ করে স্বল্প উৎপাদন পান। বীজের কালোবাজারিতে, বাণিজ্যিক সংস্থার বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনে বহু চাষি নিত্য প্রতারিত হচ্ছেন। অতএব গবেষণাপ্রসূত, পরীক্ষিত বীজ ও চাষের অন্যান্য উপকরণের প্রয়োজন কমেনি। অথচ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির চাহিদা পূরণে বাজার অনাগ্রহী। চাষিকে সম্পূর্ণ বাজার-নির্ভর করে রাখলে বাংলার চাষ আরও উন্নত, লাভজনক হবে, সে সম্ভাবনা কম। অতএব সরকারি বীজ-খামারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে কি না, তা ফের চিন্তা করতে হবে।