প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
নামাবলি ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আর্বান নকশাল, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং, আন্দোলনজীবী, ইত্যাদির পরে সাম্প্রতিকতম সংযোজন: কলমওয়ালা নকশাল। হরিয়ানার সুরজকুণ্ডে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ‘চিন্তন শিবির’ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, বন্দুকধারী অতি-বামদের পাশাপাশি কলমধারী অতি-বামদেরও নির্মূল করা দরকার, তা না হলে দেশের যুবসমাজকে তাঁরা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করে চলবেন, দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। যাদৃশী ভাবনা যস্য। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মনন-সঙ্গীরা যে ধারার চিন্তনে অভ্যস্ত, তাতে তাঁদের চিন্তাসমুদ্র মন্থন করে এমন বাণী উঠে এলে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিরোধী রাজনীতিক, নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী, স্বাধীনচেতা আইনজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিসরে সচেতন ও সক্রিয় নাগরিকরা অনেকেই বলেছেন, সঙ্ঘ পরিবারের শাসকরা যে কোনও প্রতিবাদের প্রতিই অসহিষ্ণু, তাই ক্রমাগত নিজেদের মস্তিষ্ক হাতড়ে এমন সব তকমা আমদানি করে প্রতিবাদীদের দাগিয়ে দেন এবং আক্রমণের নিশানা করে তোলেন, প্রধানমন্ত্রীর নববিধানটিও তারই আর এক নমুনা। বিরোধী মতের প্রতি শাসকদের অসহিষ্ণুতা গত সাড়ে আট বছর ধরেই আসমুদ্রহিমাচল প্রকট! যে প্রধানমন্ত্রী আজ অবধি সংবাদমাধ্যমে কার্যত কোনও যথার্থ প্রশ্নবাচী সাক্ষাৎকারে অবতীর্ণ হননি, তিনি— বিরোধিতা দূরস্থান— ভিন্নমতকে কী চোখে দেখেন সে কথা নতুন করে বলবার কিছুমাত্র প্রয়োজন আছে কি?
প্রশ্নটা অন্য। ‘কলমধারী নকশাল’দের নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রশক্তির যথেচ্ছ প্রয়োগ দেশ জুড়ে ঘটেই চলেছে, তেমন কত ‘বিপজ্জনক’ মানুষ বছরের পর বছর কারাবন্দি হয়ে আছেন, কেউ কেউ কারাগারেই প্রাণও হারিয়েছেন, সেই বৃত্তান্ত তো কারও অজানা নয়! তা হলে প্রবলপরাক্রমী সর্বাধিনায়কের আজ নতুন করে এই দমন নীতি ঘোষণার দরকার হল কেন? একটি সম্ভাব্য কারণ নিহিত আছে স্থানকালপাত্রে। বিভিন্ন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শটির তাৎপর্য সহজবোধ্য। এতদ্দ্বারা তিনি রাজ্য সরকারগুলিকেও বিরোধী দমন অভিযানে শামিল করতে উদ্যোগী হয়েছেন। কেবল বিজেপি শাসিত রাজ্য নয়, অন্য রাজ্য সরকারগুলিকেও আপন আপন এলাকায় ‘বেয়াড়া’ কলমধারীদের প্রতি কঠোর হওয়ার এই উপদেশ বর্ষণের মধ্যে এক ধরনের চতুর কৌশল আছে বইকি। ভিন্নমতের প্রতি, বিশেষত রাজনীতির প্রশ্নে মৌলিক বিরোধিতার প্রতি অসহিষ্ণুতা কেবল বিজেপি সরকারের আচরণেই দেখা যায়, তা বলার কোনও উপায় নেই, শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অন্য নানা দলের নেতা বা নেত্রীরাও হয়তো মনে মনে প্রধানমন্ত্রীর দমন নীতিতে সায় দেবেন।
দ্বিতীয় একটি কারণও থাকা সম্ভব। এক কথায় বললে তার নাম: উদ্বেগ। দেশ জুড়ে সমস্ত পরিসরে কেন্দ্রীয় শাসকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত অভিযান অনেক দূর সফল— গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে গণ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাঁবে আনা গিয়েছে; বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকেই, তদন্তের ভয়ে হোক বা নানা ধরনের প্রাপ্তিযোগের বিনিময়েই হোক, শিবির অথবা সুর বদলেছেন; সংসদের কথা বলা বাহুল্য; কিন্তু এখনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তা ও চেতনার অধিকারী নাগরিকদের সম্পূর্ণ স্তব্ধ করা যায়নি। এবং শাসকরা নির্বোধ নন, তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন যে, রাষ্ট্রের বাণী কিংবা বিবিধ তোতাপাখির কণ্ঠে সেই বাণীর প্রতিধ্বনি অপেক্ষা এই স্বাধীন নাগরিকদের প্রতিস্পর্ধী অভিমতের সামাজিক প্রভাব বহুগুণ প্রবল, তার সত্যমূল্যের কারণেই প্রবল। কথোপকথন বা বিতর্কের সুস্থ গণতান্ত্রিক পন্থায় এই ভিন্নমতের মোকাবিলা করার সামর্থ্য যদি শাসকের না থাকে, তা হলে দমন নীতিকেই তাঁরা বেছে নেন। যুক্তিতর্কের ক্ষমতা না থাকলে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের নমুনা ইতিহাসে নতুন নয়।