—প্রতীকী ছবি।
অর্থব্যবস্থার যদি উন্নতিই হয়, তা হলে যথেষ্ট সংখ্যক ভাল চাকরি কোথায়? লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বিভিন্ন পরিসরে বারে বারেই বলছেন যে, দেশে বেকারত্বের হার কমেছে, লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট (অর্থাৎ, দেশের কর্মক্ষম বয়ঃসীমার মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর যত শতাংশ কাজের বাজারে যোগ দিতে চান)-ও বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে জোর গলায় বলেছিলেন যে, মেয়েদের মধ্যে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট গত দু’দশক ধরে নিম্নমুখী ছিল, এখন তা বেড়েছে। পরিসংখ্যানগুলির মধ্যে একটিও মিথ্যা কথা নেই। কিন্তু, নেতারা বিলক্ষণ জানেন, শুষ্ক পরিসংখ্যান দিয়ে সাধারণ মানুষকে সাময়িক ভাবে ভুল বোঝানো যায় বটে, কিন্তু দিনের শেষে প্রত্যেকেই নিজের অবস্থাটি টের পান। তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, ভারতে বেকারত্ব হ্রাসের পিছনে বৃহত্তম অবদান রয়েছে পারিবারিক অবৈতনিক কাজে কর্মসংস্থানের (‘কাজের বাজার অন্ধকার, মৈত্রীশ ঘটক, আবাপ পৃ৪, ১-৩)। যেমন, পারিবারিক কৃষিকাজে বিনা বেতনে কাজ করা, অথবা পারিবারিক মুদিখানায় বসা। স্বভাবতই, মানুষের সামনে যখন অন্য কোনও উন্নততর বিকল্প থাকে, অর্থাৎ যেখানে কাজ করলে টাকা রোজগার করা যায়, তখন কেউ এই ধরনের কাজ করেন না। শ্রমশক্তিতে মহিলাদের যোগদানের হার বৃদ্ধির পিছনেও রয়েছে বিনা বেতনে পারিবারিক ক্ষেত্রে কাজ। অন্য দিকে, প্রকৃত আয়বৃদ্ধিও কর্মসংস্থানের সিংহভাগ ক্ষেত্রে অতি ক্ষীণ। সব মিলিয়ে, ভারতে কর্মসংস্থানের গুণগত মানের অবনতি হয়েছে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় নেতারা হরহামেশা পেশ করে থাকেন, সেটির ভিতরের ছবিটিও তাঁরা কখনও ভেঙে বলেন না। কারণ, ভাঙলেই উপরের আপাত-ঔজ্জ্বল্য উবে যাবে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু মনে করিয়ে দিলেন, তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের মাপকাঠিতে ভারত সিরিয়া, আর্মেনিয়া, লেবানন, ইয়েমেন বা ইরানের মতো গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ বিধ্বস্ত দেশগুলির সঙ্গে এক সারিতে বসে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন কর্মহীন। শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করলে, ভারতে বেকারত্ব সর্বাধিক উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে— স্নাতক ও তদূর্ধ্ব স্তর অবধি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের পক্ষে কাজ জোগাড় করা সবচেয়ে কঠিন। এই পরিসংখ্যানগুলিও কর্মসংস্থানের গুণগত মানের সার্বিক অবনতির দিকে ইঙ্গিত করছে।
অর্থব্যবস্থায় কর্মসংস্থানের দু’টি গুরুত্বের কথা পৃথক ভাবে উল্লেখ করলে বোঝা যাবে, এই অবস্থাটি কেন গভীর ভাবে উদ্বেগজনক। প্রথমত, দেশের বেশির ভাগ মানুষই যে-হেতু পুঁজি বা জমি থেকে প্রাপ্ত খাজনার মাধ্যমে উপার্জন করেন না, করেন শ্রমের বিনিময়ে মজুরির মাধ্যমে, ফলে শ্রমের বাজার ঝিমিয়ে থাকার অর্থ, দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি বেশির ভাগ মানুষের কাছে যথাযথ ভাবে পৌঁছচ্ছে না। তাতে আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধি পায়। ভারতে আর্থিক অসাম্যর যে উদ্বেগজনক ছবিটি গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি সেটিকে বহুলাংশে ব্যাখ্যা করতে পারে। দ্বিতীয় কথা হল, ভারতে নিয়মিত বেতনযুক্ত কাজে, অথবা কর্মী নিয়োগ করতে পারেন এমন স্বনিযুক্তির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের স্থবিরতা বলছে যে, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার জন্য যেমন শিল্প প্রয়োজন, ভারত সে পথে হাঁটতে পারেনি। সাঙাততন্ত্র এবং সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সাঁড়াশিতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা আটকে পড়েছে। ফলে, উদ্বেগটি বর্তমান নিয়ে যতখানি, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চেয়ে তিলমাত্র কম নয়। সাধারণ মানুষ এত পরিসংখ্যান যদি না-ও বা বোঝেন, তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে টের পাচ্ছেন যে, সরকার যা-ই বলুক না কেন, তাঁরা ভাল নেই। ভাল থাকবেন, তেমন আশাও ক্ষীণ।