ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। প্রতীকী ছবি।
উদ্দেশ্য মহৎ হলেই যে উদ্দেশ্য পূরণের পথটিও যুক্তিগ্রাহ্য হবে, তেমন কোনও কথা নেই। কলকাতায় যেমন পথ দুর্ঘটনা হ্রাস করতে হামেশাই পুলিশকে যে ধাতব গার্ডরেল ব্যবহার করতে দেখা যায়, তা যথেষ্ট বিপজ্জনক। ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয় যে, ধাতব গার্ডরেল রাস্তার মাঝখানে বসানো থাকলে তাতে ধাক্কা লেগে মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। এই কাণ্ডজ্ঞানের কথাটি দৃশ্যত কলকাতা পুলিশের মাথায় আসেনি। আইআইটি খড়্গপুরের এক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিলেন, রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক, ফাইবার অথবা বিশেষ ভাবে তৈরি রাবার দিয়ে নির্মিত বস্তু ব্যবহার করা বিধেয়। এবং, এগুলির রং হিসাবে হলুদ-কালো ব্যবহার করা প্রয়োজন। হলুদ-কালো সমস্ত আবহাওয়াতে, কুয়াশাঢাকা পথেও দূর থেকে দৃশ্যমান হয়। অন্য রঙে, এমনকি শাসক দলের বিশেষ পছন্দের নীল-সাদাতেও, সেই সুবিধা মেলে না।
এই আপাত তুচ্ছ বিষয়গুলি পথ-নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পায় না। কিন্তু এগুলি জরুরি। কিছু দিন পূর্বে কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রক ২০২১ সালের দেশব্যাপী পথ-দুর্ঘটনার যে হিসাব দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট শুধুমাত্র ওই একটি বছরেই সড়ক-দুর্ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮০০ জন। এই চিত্র আতঙ্কের। সুতরাং, পুলিশ-প্রশাসনের এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে দুর্ঘটনা এবং আহত-নিহতের তালিকা আরও বৃদ্ধি পায়। মনে রাখা প্রয়োজন, পথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ নয়, তা এক সার্বিক ব্যবস্থা, যেখানে প্রশাসন এবং নাগরিক— উভয়ের সদিচ্ছা একান্ত কাম্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয়, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই পথ-সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বিরাট ফাঁক থেকে গিয়েছে। কলকাতা শহরে রাতে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, উৎসবের দিনে ন্যূনতম বিধি না মেনে বাইক-গাড়ির তাণ্ডব— বছরের পর বছর এই চিত্রে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ধরা পড়ে না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা চলে পুলিশ-প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে; জেলার দিকে তেমনই তাপ্পি দেওয়া টায়ার, ভাঙা কাঠামো এবং অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলে বাস, অটো। সুতোয় ঝোলে যাত্রী ও পথচারীর ভাগ্য। অথচ, রাজ্যে নির্দিষ্ট আইন আছে, আইনভঙ্গে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু যে রাজ্যে আইন ভাঙার অধিকার কাঞ্চনমূল্যে ক্রয় করা যায়, সেখানে নাগরিকদের কাছে পথ প্রকৃতই সুরক্ষিত কি না, প্রশ্ন থেকে যায়।
অবশ্য সব দায় প্রশাসনের উপর চাপানো চলে না। এক শ্রেণির নাগরিকের অসচেতনতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণও বিপদের জন্য সমান ভাবে দায়ী। ফুটপাত সত্ত্বেও রাস্তায় নেমে আসা, সিগন্যালের তোয়াক্কা না করা, ব্যক্তিগত যানের গতির সীমারেখা না মানা তারই যৎসামান্য উদাহরণ। কিন্তু এ কথাও সত্য, প্রশাসন স্বয়ং যদি পথ-নিরাপত্তা বিষয়ে ঢিলেঢালা হয়, তবে নাগরিকও অচিরেই সেই পথের শরিক হবে। অন্যায় করেও সহজে পার পাওয়া গেলে অনিয়মই নিয়ম হবে। পথকে নিরাপদ বানাতে হলে এক দিকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো যান নিয়ন্ত্রণ বিধিকে ঢেলে সাজাতে হবে, অন্য দিকে আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। তবে, সর্বাগ্রে এই ক্ষেত্র থেকে অন্তত দলীয় পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি বাদ দিতে হবে।