এ রাজ্যে পথে নামা মানেই কি প্রাণ হাতে বেরোনো! প্রতীকী ছবি।
অতিমারির বছরটিতে প্রায়-গৃহবন্দি রাজ্যে স্বাভাবিক ভাবেই কমেছিল পথ-দুর্ঘটনার সংখ্যা, কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রক সম্প্রতি ২০২১ সালের দেশব্যাপী পথ-দুর্ঘটনার খতিয়ান প্রকাশ করেছে। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, শুধু ওই বছরটিতেই পশ্চিমবঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১০৪৫৪টি, প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮০০ জন মানুষ! এঁদের মধ্যে সিংহভাগই— ২৯১১ জন পথচারী। কী ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারীরা মারা যাচ্ছেন, সেই শ্রেণিবিন্যাসও উল্লিখিত রিপোর্টে— ১৭২২ জনের মৃত্যু হয়েছে গাড়ি বা ট্যাক্সির ধাক্কায়, বাইকের ধাক্কায় মৃত ৮৩০ জন, ট্রাক-লরি দুর্ঘটনায় ৬১৪ জন, বাসের ধাক্কায় একশোর কাছাকাছি, এমনকি অটো দুর্ঘটনাও কাড়ছে পথচারীর প্রাণ। গাড়ি, ট্যাক্সি, বাইক, অটো, টোটো, ই-রিকশা, সাইকেল— বিভিন্ন যানবাহনের চালক বা যাত্রীদেরও প্রাণ যাচ্ছে দুর্ঘটনায়, বাইক-আরোহীদের সবচেয়ে বেশি— কিন্তু তার পাশে পথচারীদের মৃত্যুর সংখ্যাটি এতই যে, আতঙ্ক হয়, এ রাজ্যে পথে নামা মানেই কি প্রাণ হাতে বেরোনো!
এক বছরে প্রতি দিন গড়ে ১৫ জন মানুষের পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আতঙ্কের কারণই বটে। পরিসংখ্যান বলছে, দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটে কেন্দ্র ও রাজ্যের দায়িত্বে থাকা জাতীয় সড়কে, এবং যে দশটি রাজ্যে জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা সর্বাধিক, তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে দশ নম্বরে। অন্য বহু রাজ্যে জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনা অনেক বেশি, এ রাজ্যে কম বলে আনন্দের কোনও কারণ নেই; বছরের সার্বিক পথ-দুর্ঘটনার সংখ্যাটি ক্ষুদ্র হলে বরং সন্তুষ্টির অবকাশ থাকত। জাতীয় সড়কের চরিত্র, রক্ষণাবেক্ষণ, সেখানে চলাচল করা যানবাহনের বিন্যাস, তাদের গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি ও প্রয়োজন মতো দণ্ডবিধান— এই সব কিছুই যথাযথ ভাবে দেখা হচ্ছে কি না, তার উপরে জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকাংশে নির্ভর করে। পশ্চিমবঙ্গ সেই সব দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমাতে পারলেও, বোঝাই যাচ্ছে, রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় অন্যান্য সড়কপথে দুর্ঘটনা থামছে না।
এখন অবিলম্বে প্রয়োজন এই অন্য সড়কগুলিরও হাল ফেরানো। রাজ্য পরিবহণ দফতরের বোঝা দরকার, কেবল কলকাতা থেকে দিঘাগামী সড়ককে মসৃণ ও সুখযাত্রা-উপযোগী করাটাই কাজ নয়, গঙ্গাসাগর মেলা আসছে বলে কলকাতা থেকে কাকদ্বীপ-নামখানা অভিমুখী প্রধান সড়কপথগুলির দিকে সাময়িক নজর দিয়েই ক্ষান্ত হলে চলবে না। দরকার দার্জিলিং থেকে পুরুলিয়া এবং গঙ্গাসাগর পর্যন্ত কোন কোন প্রধান সড়কগুলি দুর্ঘটনাপ্রবণ তা খতিয়ে দেখা, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কিংবা আন্তঃজেলা যাতায়াত, যোগাযোগ ও অর্থনীতির জন্যও যে সড়কগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ উপেক্ষিত— অপরিসর বা মেরামতিহীন, তাদের চিহ্নিত করে সেগুলির হাল ফেরানো। পথের স্বাস্থ্যোদ্ধার, পাশাপাশি যানবাহনের নিয়মকানুন, গতিবেগ নিয়ন্ত্রণে নজরদারি, সিগন্যাল গতিরোধক ও পথনির্দেশের সুব্যবস্থা— সব কিছুই আরোহী ও পথচারীর জীবন বাঁচাবে, নান্যঃ পন্থাঃ। দুর্ঘটনাহীন সড়কপথ স্রেফ রাজ্যের পরিবহণ চিত্রেরই সুবিজ্ঞাপন নয়, রাজ্যবাসীর নিরাপদ জীবনেরও অভিজ্ঞান। নতুন বছরের গোড়া থেকেই রাজ্য সরকার এ দিকে নজর দিক। পথ পৌঁছে দিক জীবনে, তা যেন কখনও মৃত্যু-পথ হয়ে না দাঁড়ায়।