আন্তর্জাতিক সমালোচনার চাপে বিজেপি এবং তার সহমর্মী ও সহযোগীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কুপথ থেকে সরে আসবে, তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই মুহূর্তে অনেকগুলি রাষ্ট্রের— এবং কার্যত রাষ্ট্রপুঞ্জের— প্রবল প্রতিবাদের মোকাবিলা করতে নরেন্দ্র মোদীকে কিঞ্চিৎ সচল হতে হয়েছে, দু’এক জন দলীয় কর্মকর্তা ‘শাস্তি’ পেয়েছেন (অচিরেই তাঁরা পুরস্কার পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না)। উপরি হিসাবে দলের তরফে বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে যে, তাদের হৃদয় নাকি সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমদৃষ্টিতে টইটম্বুর! এমন আত্মসংশোধনের ‘তৎপরতা’ নিশ্চয়ই জগৎসভায় নিন্দিত হওয়ার লজ্জায় বা অনুতাপে নয়। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ব্যাপ্তি এবং মাত্রায় দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে, তার পরিণামে কূটনীতির মঞ্চে, নিরাপত্তার পরিসরে এবং বিশ্ব বাজারে সমস্যা বাড়তে পারে— এই সত্যটি টের পেয়েই দিল্লীশ্বররা পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হয়েছেন, বিশেষত অর্থনৈতিক প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় প্রভাবশালী শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীরা তাঁদের তৎপর হতে বাধ্য করেছেন, এমন কথা মনে করার যথেষ্ট হেতু আছে। হয়তো তাঁরা এটাও বুঝেছেন যে, ধর্ম-দ্বেষের প্রকাশটা যে ভাবে হয়েছে সেটা অতিমাত্রায় বিপজ্জনক, এখনই জল না ঢাললে ক্ষোভ এবং ক্রোধের তেজ সামলানো যাবে না। সে-ভয় না থাকলে তাঁরা সম্ভবত অভিযোগ অস্বীকার করার অভ্যস্ত পথেই হাঁটতেন।
ঠিক যেমনটি তাঁরা কয়েক দিন আগেই হেঁটেছিলেন। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে আমেরিকান বিদেশ দফতরের বার্ষিক সমীক্ষা রিপোর্টে (২০২১) অভিযোগ করা হয়েছে, ভারতে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ক্রমাগত নানা ধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই বিষয়ে আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন-এর বক্তব্য: দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং বহু ধরনের ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বাসভূমি ভারতে উপাসনাস্থলে আক্রমণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। অভিযোগের নিশানাটিকে আরও নির্দিষ্ট করে দিয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার নজরদার ‘অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ’ অর্থাৎ বিশ্ব-পরিসরে কর্মরত আমেরিকান কূটনৈতিক প্রতিনিধি রাশাদ হুসেন বলেছেন, “ভারতে কিছু সরকারি কর্তাব্যক্তি ধর্মীয় উপাসনাস্থল এবং লোকজনের উপর আক্রমণকে উপেক্ষা করছেন, এমনকি তাতে মদত দিচ্ছেন।” এর উত্তর দিতে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক দেরি করেনি। তারা বিবৃতি দিয়েছে যে, পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এবং আমেরিকার নির্বাচনী রাজনীতির তাড়নায় এই অভিযোগ আনা হয়েছে। দিল্লীশ্বররা এখানে থামেননি, আমেরিকায় বর্ণ-বিদ্বেষী হিংসা, যথেচ্ছ বন্দুকবাজি ইত্যাদির যে দাপট দেখা যাচ্ছে সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, ইটের বদলে পাটকেল।
আমেরিকান রাষ্ট্রের দ্বিচারিতা নিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহকর্মীরা বিলক্ষণ জানেন, দুনিয়া জুড়ে ভারত সম্পর্কে ক্রমাগত কুৎসিত এবং ভয়ানক ধর্ম-দ্বেষের অভিযোগ কেন উঠছে, কেন তার মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। সত্য এই যে, উদার গণতান্ত্রিক সহিষ্ণু ভারত এখন দুনিয়ার চোখে ঐতিহাসিক স্মৃতিমাত্র, মোদীর ভারত হিন্দুরাষ্ট্রের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সেই রাষ্ট্র এবং তার ধারকরা কেবল অসহিষ্ণুতা নয়, বিদ্বেষের কারবারি। সংখ্যালঘুরা তার প্রধান শিকার। এই কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ‘খুচরো’ লোকজনের সৃষ্টি নয়, এর সমস্ত দায় এবং দায়িত্ব বর্তায় শাসক দল তথা গোষ্ঠীর নায়কনায়িকাদের উপরেই। ‘নীচের তলা’র নেতা-কর্মীরা যে এখনও, এই আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের মুখেও সংযত না হয়ে তাঁদের বিদ্বেষী স্পর্ধার চিৎকার চালিয়ে যেতে পারছেন, তার দায়ও সপারিষদ নরেন্দ্র মোদী অস্বীকার করতে পারেন না। তাঁর মহিমময় নীরবতা সেই সত্যকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।