—ফাইল চিত্র।
ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেল’। কিংবা, পরে। একদা ইংরেজি ব্যাকরণ শিক্ষার বইয়ে ক্রিয়াপদের রকমসকম শেখাতে এ-হেন উদাহরণের খুব চল ছিল। উদাহরণ তো যুগে যুগে জীবন থেকেই নেওয়া, এ কালের জনজীবন থেকে এমনই উদাহরণ বেছে নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে হয়তো দেখা যেত এমন নমুনা: ‘বর্ষা আসিতে না আসিতেই একের পর এক সেতু ভাঙিয়া পড়িল’, বা ‘প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করিবার তিন মাস পরেই এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভাঙিয়া পড়িল’। অথবা এমনও, ‘ট্রেনযাত্রা শেষ হইবার পূর্বেই আপার বার্থ ভাঙিয়া যাত্রীর মৃত্যু হইল’। কিংবা এ-ও: ‘অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের কয়েক মাস না যাইতেই ছাদ দিয়া জল পড়িতে লাগিল’। ছাত্রছাত্রীদের একই সঙ্গে ব্যাকরণ আর অনুবাদও মকশো হবে, মন্দ কী!
শেখার কোনও শেষ নেই। উদাহরণগুলি দেখে ভ্রু কুঁচকালেও এ-ই শেষ কথা, সহজ সত্য। কিন্তু ভারতের শাসকেরা এই উদাহরণ চোখের সামনে দেখেও আর কবে শিখবেন তা বলা শক্ত। বিহারের কয়েকটি জেলায় গত দশ দিনে পাঁচটি সেতু ভেঙে পড়েছে, কোনওটি পুরনো, কোনওটি নির্মীয়মাণ; অতি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে ও মণিপুরেও একটি করে। মণিপুরের ঘটনাটি ভয়ঙ্কর— সদ্য তৈরি-হওয়া সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে গেল ট্রাক, চালক ভিতরে আটকে মারা গেলেন। এ নাহয় এক-একটি বর্ষাপীড়িত রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকার পরিস্থিতি, কিন্তু কী বলা যায় খাস রাজধানী দিল্লিতে এয়ারপোর্ট টার্মিনালের ‘ক্যানোপি’ ভেঙে পড়ে ক্যাবচালকের মৃত্যুর ঘটনাকে— প্রসঙ্গত গত মার্চ মাসে এই বিমানবন্দরের নতুন, প্রসারিত, সুসংবদ্ধ অবতার উদ্বোধন করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী! রেল-দুর্ঘটনা তো ছেড়েই দেওয়া যাক, দেশ জুড়ে রেলের যাবতীয় অব্যবস্থা— ট্রেন বাতিল, যাত্রাপথে অস্বাভাবিক দেরি, স্লিপার ও এসি কামরায় টিকিটহীন যাত্রীদের বাড়বাড়ন্তে প্রকৃত যাত্রীদের দুরবস্থা,
এই সব কিছু সহ্য করার পরেও প্রাণটুকু বাঁচছে না, আপার বার্থ ভেঙে মৃত্যু হচ্ছে লোয়ার বার্থের যাত্রীর। দেবতার মানের পাশে নাগরিকের প্রাণের দাম আর কতটুকু, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তাতেও গেরো: লোকসভা ভোটে বিজেপির তুরুপের তাস আর পৌষমাস হয়ে ওঠার কথা ছিল যে রামমন্দিরের, তারই ছাদ চুইয়ে জল পড়ছে; জুনের বৃষ্টিতে অযোধ্যার ‘রাম পথ’-এ জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ।
তা হলে ভারতশাসকদের হাতে রইল কী? অবশ্যই পেনসিল: চার দিকে হয়ে চলা যাবতীয় ভুল শুধরে নেওয়ার, কোন ‘ক্রিয়া’টির আগে কোন ‘ক্রিয়া’ অর্থাৎ কাজটি করা দরকার তা বোঝার। বর্ষা শুরু হতে না হতেই কেন এ দেশে সেতু থেকে বিমানবন্দর, মন্দিরের ছাদ থেকে ট্রেনের বার্থ ভেঙে পড়ে তা ভারতের সাধারণতম নাগরিকমাত্রেও জানেন— প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনে আছে সরকারি অব্যবস্থা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, গাফিলতি এবং সর্বোপরি দুর্নীতি। এ দেশের দরিদ্রতম মানুষটিও বর্ষা আসার আগে তাঁর জীর্ণ ঘরের চালাটি শক্ত করে বাঁধেন, অথচ সরকারের সড়ক নির্মাণ, পরিবহণ, গ্রামোন্নয়ন, পূর্ত, রেল বা অসামরিক বিমান চলাচল দফতরের অভিধানে দূরদৃষ্টি বা পূর্বপ্রস্তুতি শব্দগুলি নেই, বর্ষার আগে যে, সেতু, রাস্তা, পুরনো বাড়ি, মন্দির, রেলপথ এই সবই পরিদর্শন প্রয়োজন, সেই শিক্ষাটুকু নেই। কোন ঠিকাদার তথা নির্মাণ সংস্থা সরকারি বরাত পাবে তা নিয়ে দুর্নীতি আছে; আর আছে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে নির্লজ্জ সাফাই, গা বাঁচানো, লোক-দেখানো তদন্ত ও বরখাস্তের নাটক। মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পর টনক নড়া আছে, আগে থেকে কী করলে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হত না তার বোধ নেই। অথচ এই সবই সহজ ব্যাকরণ, সরকারের পক্ষে তা শেখাও সহজতর, কারণ তার হাতে ক্ষমতা অর্থ পরিকাঠামো সবই মজুত। এই দেশের দুর্ভাগ্য, সরকারের সেই ব্যাকরণ শেখা হল না। রোগী মরিবার পূর্বে ডাক্তার আসিল না।