ফাইল চিত্র।
রাজ্যবাসী প্রশ্ন করিতে পারেন, “এত দিন কোথায় ছিলেন?” সারদা-নারদ কাণ্ড ঘটিয়াছে অর্ধ দশকেরও অধিক সময় পূর্বে। কয়লা পাচার সংক্রান্ত অভিযোগও দীর্ঘ দিনের। তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, বিলক্ষণ। অভিযোগের গুরুত্ব অনুসারে দেশের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-কে সেই দায়িত্বও দেওয়াই চলে। বস্তুত, তাহা দেওয়াই বিধেয়। কিন্তু, নির্বাচনের ঋতু আসিলেই মরসুমি পাখির ঝাঁকের ন্যায় সিবিআই তদন্তকারীরা দিল্লি হইতে আসিবেন, এবং নির্বাচন মিটিলে উড়িয়া যাইবেন ভিন্ন কোনও নির্বাচনমুখী রাজ্যের অভিমুখে— এই দস্তুরটি হইতেই প্রশ্ন উঠে, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী যেমনটি বলিয়াছিলেন, সিবিআই-এর ন্যায় কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি কি শাসক দলের আজ্ঞাবহ দাস ভিন্ন আর কিছুই নহে? একদা যে সংস্থার তদন্তের নামে অপরাধীদের বুকে কাঁপন ধরিত, জনমানসে সেই সংস্থার তিলমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা নাই কেন, এই প্রশ্নের উত্তর সংস্থাগুলিকেই খুঁজিতে হইবে। দেশের স্বনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি এই জমানায় হইতেছে, তাহা অপূরণীয়।
ঘটনা হইল, শাসক দলের আজ্ঞাবহ হইবার অভিযোগটি সিবিআই-এর ন্যায় সংস্থার বিরুদ্ধে নূতন নহে। বর্তমান শাসকরা ইউপিএ-র আমলে সিবিআই-কে খাঁচার তোতা বলিয়া বিস্তর অভিযোগ ও রঙ্গরসিকতা করিতেন। কিন্তু, সেই তোতার মালিকানা পাইবার পর খাঁচার দরজাটি তাঁহারা যেমন কষিয়া আঁটিয়া দিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ, তেমনটা পূর্বে কখনও ঘটে নাই। দেশের কার্যত সব বিরোধী নেতাই অভিযোগ করিয়াছেন যে, সিবিআই আদি সংস্থাকে ব্যবহার করা হইতেছে তাঁহাদের কণ্ঠরোধ করিতে। কংগ্রেস নেতা ও ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমের গ্রেফতারি ও হাজতবাস তাহার একটি মোক্ষম উদাহরণ। যে অভিযোগে চিদম্বরমকে আটক করা হইয়াছিল, তাহা বড় জোর পরোক্ষ অপরাধ— তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন একটি সংবাদসংস্থা আর্থিক বেনিয়ম করিয়াছিল, এবং তিনি তাহাতে বাধা দেন নাই। অভিযোগটি অগ্রাহ্য করিবার মতো নহে ঠিকই, কিন্তু ইহার তুলনায় ঢের বেশি গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে সিবিআই-এর নিষ্ক্রিয়তা বা শ্লথতায় কাহারও সন্দেহ হইতে পারে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন চিদম্বরম অমিত শাহকে হয়রান করিয়াছিলেন বলিয়া এই দফায় সিবিআই সেই প্রতিশোধের হাতিয়ার হইল। মধ্যপ্রদেশে ব্যপম কেলেঙ্কারি, বা কর্নাটকে খনি কেলেঙ্কারির তদন্তের ক্ষেত্রে সিবিআই-এর ভূমিকা দেখিলে এই সন্দেহটি তীব্রতর হইতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গেও অভিযোগ কম নহে। এখন যাঁহারা বিজেপির সভা আলো করিয়া বসেন, এমন বহু ব্যক্তিকেই নারদ-কাণ্ডের ভিডিয়োয় রাজ্যবাসী দেখিয়াছেন। সারদা পর্বেও যাঁহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির, তাঁহাদের অনেকেই এখন বিজেপি শিবিরে। তাঁহাদের প্রতি সিবিআই একই রকম কঠোর হইবে কি? অতীত অভিজ্ঞতাকে সাক্ষী মানিলে তেমন দাবি করিবার উপায় নাই। কোনও বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত কেন হইতেছে, তাহা প্রশ্ন নহে। নেতাটি যিনিই হউন, অভিযোগ উঠিলে তদন্ত হওয়াই বিধেয়। প্রশ্ন, সিবিআই-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা লইয়া। রাজনৈতিক রং বাছিয়া তদন্ত করা— মতান্তরে, হয়রান করা— সিবিআই-এর কাজ হইতে পারে না। নির্বাচনের পূর্বে বিরোধীদের দমন করিবার রাজনৈতিক প্রকল্পের হাতিয়ার হইবার দায় তাহাদের নাই। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকিবে, সেই দলই সিবিআই-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠানকে কম-বেশি ব্যবহার করিতে চাহিবে। দুর্ভাগ্যজনক হইলেও ইহাই ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব। সেই প্রবণতাটিকে ঠেকাইতে হইলে প্রতিরোধ করিতে হইবে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর হইতেই। কর্তাদের স্মরণে রাখিতে হইবে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরাইবার আর দ্বিতীয় কোনও পন্থা নাই।