সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতেও এমন ঘটনা ‘নজিরবিহীন’— রাজ্য এতখানি নীচে এর আগে নামেনি। ফাইল চিত্র।
পতনের যে সত্যিই কোনও সীমা হয় না, কলকাতা তা আরও এক বার প্রমাণ করল। হাই কোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার এজলাসের বাইরে বিক্ষোভ দেখালেন এক দল আইনজীবী, তাঁর আদালত বয়কট করা হল; তাঁর পাড়ায় কুরুচিকর পোস্টার পড়ল। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতেও এমন ঘটনা ‘নজিরবিহীন’— রাজ্য এতখানি নীচে এর আগে নামেনি। বিচারপতির এজলাস বয়কট, ঘেরাওয়ের নিদর্শন অবশ্য আছে। গত বছরই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আদালতের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আইনজীবী সেলের সদস্যদের একাংশ। জানা গিয়েছে, তদন্ত শুরু করলেও সোমবার রাত অবধি পুলিশ জানতে পারেনি যে, এ বারের ঘটনার পিছনে কারা দায়ী। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্রও এই ঘটনার সঙ্গে দলের যোগ অস্বীকার করেছেন। তবে, বিচারপতির বিরুদ্ধে যে পোস্টার পড়েছে, তাতে একই সঙ্গে বিরোধী দলনেতাকে রক্ষাকবচ দেওয়া, এবং তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীরকে রক্ষাকবচ না দেওয়ার প্রসঙ্গের যুগ্ম উপস্থিতি দেখলে বিক্ষুব্ধদের রাজনৈতিক রঙের আভাস পাওয়া সম্ভব। কিন্তু, কথাটি কোনও বিশেষ দলের নয়। মনে পড়তে পারে বাম আমলে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অমিতাভ লালার সম্বন্ধে বিমান বসুর মন্তব্যটিও। বিচারপতির রায়মাত্রেই তা সবার পছন্দ হবে, এমন নয়। রায় মনঃপূত না হলে উচ্চতর আদালতে আপিল করার ব্যবস্থাটিও ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় সুপরিচিত। কিন্তু, বিচারপতির বিরুদ্ধে কটূক্তি, তাঁকে হয়রান করার এই সংস্কৃতির পিছনে যে রাজনৈতিক ক্লেদ হয়েছে, তা স্তম্ভিত করার মতো।
অনুমান করা চলে যে, এই অসভ্যতা কেবলমাত্র অসভ্যতার খাতিরেই নয়, এর গূঢ়তর উদ্দেশ্য হল বিচারকদের মনে এক ধরনের আতঙ্কের সঞ্চার করা। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এর পর হয়তো বিচারকদের শারীরিক ভাবে নিগ্রহের ঘটনাও ঘটতে পারে। তা সত্যিই ঘটবে কি না, সে জল্পনা অবান্তর— এমন একটি আশঙ্কা যে তৈরি হতে পারে, সে কথাই গভীর লজ্জা এবং উদ্বেগের। বিচারকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেই চাপের প্রভাব তাঁদের সিদ্ধান্তের উপরেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জয়ন্তবাবু। ক্ষুদ্র রাজনীতির পালে হাওয়া দিতে যদি বিচারব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়, সেই ক্ষতি অপূরণীয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিচালকরা আত্মসমীক্ষা করতে পারেন— যে গণতন্ত্রের পরিসরে তাঁরা রাজনীতি করেন, তার মূলে কুঠারাঘাত করা কী বিপুল অবিবেচনার কাজ। বিচারপতি মান্থার বিরুদ্ধে এই ‘বিক্ষোভ’-এর পিছনে সংগঠিত রাজনীতির কলকাঠি নেই, এমন কথা বিশ্বাস করা অসম্ভব। যাঁরা এই কাজটি করাচ্ছেন, তাঁরা পরিণামের কথা মাথায় রাখুন।
এই ক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব প্রশাসনের। প্রকাশ্য দিবালোকে যারা জনবহুল এলাকায় বিচারপতির বিরুদ্ধে পোস্টার লাগিয়ে যায়, তাদের সন্ধান না পাওয়া গেলে পুলিশের কর্মদক্ষতা এবং সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হোক। কিন্তু সেখানেই থেমে গেলে চলবে না। অনুসন্ধান করা প্রয়োজন যে, এই ঘটনার পিছনে কাদের মদত রয়েছে। তাদেরও শাস্তি হওয়াই বিধেয়। আদালতের আইনজীবীদেরও সংযত করা বিধেয়। বিচারপতি মান্থা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিক্ষোভকারী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন; আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন। এই আইনজীবীদের ভাবতে হবে, যে রাজনৈতিক আনুগত্য তাঁদের পেশার প্রতি, নীতিবোধের প্রতি এতখানি অশ্রদ্ধা পোষণ করতে শেখায়, তা শেষ অবধি কোথায় পৌঁছবে।