Visva Bharati

যক্ষপুরী

বিশ্বভারতী একা নহে। ইতিমধ্যে গোটা দেশ জুড়িয়া একাধিক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ভয়ের শাসন সেগুলিকে ‘যক্ষপুরী’তে পরিণত করিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:১৩
Share:

বিশ্বভারতীর অচলাবস্থা আপাতত কাটিল। কিন্তু স্বস্তি আসিল কি? বিশ্বভারতীর মূল সঙ্কট আইনভঙ্গের নহে, শিক্ষার আদর্শবিচ্যুতির। ছাত্র-আন্দোলন এই রাজ্য কম দেখে নাই। নানা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ নানা সময়ে উত্তাল হইয়াছে, কিন্তু প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্র যেখানে ‘সহচিত্ত’ থাকিয়াছে, সেখানে সহমত না হইলেও সমাধান-সূত্র মিলিয়াছে। এই দিকে বিশ্বভারতী শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করিয়াছে, তাহাদের সকল আবেদন অগ্রাহ্য করিয়াছে। ইহার অভিঘাত শান্তিনিকেতনের গণ্ডি ছাড়াইয়াছে, বিভিন্ন ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন প্রতিবাদে আন্দোলিত হইয়াছে। হাই কোর্টও বলিয়াছে, ইহা যেন ‘লঘু পাপে গুরুদণ্ড’। কেবল ছাত্র-বহিষ্কার কেন— আন্দোলনরত শিক্ষক-ছাত্রদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের আট জনকে বরখাস্ত করা হইয়াছে, উনিশ জনকে সাসপেন্ড করা হইয়াছে, ছয় জনকে ‘অধ্যক্ষ’, ‘বিভাগীয় প্রধান’ প্রভৃতি পদ হইতে সরানো হইয়াছে, আট জনের বেতন ও অবসরকালীন প্রাপ্তি আটকানো ও তিরিশ জনেরও অধিক কর্মীকে কারণ দর্শাইবার নোটিস ধরানো হইয়াছে। একাধিক শিক্ষককে সর্বসমক্ষে অপমান করিবার অভিযোগও উঠিয়াছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। অধিকাংশ ‘দণ্ডিত’ আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছেন। কিসের দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিতে ব্যস্ত বর্তমান বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ? কোন যুক্তি দিয়া তাঁরা এই প্রবল বিশৃঙ্খলার ব্যাখ্যা দিতেছেন?

Advertisement

১৯১৬ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সম্মুখে মহাত্মা গাঁধী ছাত্রদের বলিয়াছিলেন, “যদি ঈশ্বরকে ভয় করিতে হয়, তবে আর কাউকে ভয় করা চলিবে না— দেশি মহারাজাদের নহে, লাটসাহেবদের নহে, গোয়েন্দাদের নহে, এমনকি রাজা জর্জকেও নহে।” এই নিঃশঙ্ক সত্যবাদিতাই কিন্তু ভারতে শিক্ষার আদর্শ। সুতরাং যেখানে সপ্রশ্ন প্রতিবাদীর প্রতি শাস্তির খড়্গ সদা-উদ্যত, সেই প্রতিষ্ঠান স্বাধীন চিন্তার বধ্যভূমি। তবে স্বাধীনতার নামে ছাত্র বিশৃঙ্খলা অবশ্যই সমর্থনীয় নহে। ছাত্রদের দাবি ন্যায্য হইতে পারে, তাহার জন্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তাকে ঘরবন্দি ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না। বাস্তবিক, পশ্চিমবঙ্গ ‘ঘেরাও’ রাজনীতির দাস উনিশশো ষাটের দশক হইতেই। কিন্তু আগেকার তুলনায় অমানবিকতা বাড়িয়াছে বহুগুণ। ঘেরাও প্রথার মধ্যেও আগে শিক্ষক-ছাত্রের পারস্পরিক শ্রদ্ধা-স্নেহ টের পাওয়া যাইত, এখন সকলেই সকলের শত্রু, প্রতিপক্ষ। অতএব উপাচার্যের বাসভবনের সম্মুখ হইতে প্রতিবাদীদের অবস্থান অপসারণ করিবার নির্দেশ যথাযথ। কিন্তু একই সঙ্গে উপাচার্যকেও সংযত হইতে বলিবার জন্য আদালতকে ধন্যবাদ। সংযম এমনিতেই একটি মহৎ গুণ, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষব্যক্তির সংযম নিছক প্রত্যাশা নহে, তাহা আবশ্যিক। উদারতা, সহানুভূতি, মতবিনিময়ে আগ্রহ, এইগুলিও উপাচার্য হইবার আবশ্যিক শর্ত। ভয় দেখাইয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো যায় না।

বিশ্বভারতী একা নহে। ইতিমধ্যে গোটা দেশ জুড়িয়া একাধিক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ভয়ের শাসন সেগুলিকে ‘যক্ষপুরী’তে পরিণত করিয়াছে। সম্প্রতি কেরলের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক টিকা রফতানি নীতির সমালোচনা করিয়া তদন্ত কমিটির মুখে পড়িয়াছেন, ‘জাতীয়তা-বিরোধী’ মন্তব্যে শিক্ষকদের শাস্তিদানের বিজ্ঞপ্তি বাহির হইয়াছে। একই অভিযোগ উঠিয়াছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, যাঁহারা নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করিয়াছেন। তবু বিশ্বভারতী আলাদা করিয়া চিত্ত বিকল করে। কারণ, ইহার প্রতিষ্ঠাতা একদা চঞ্চল বালকদের শাস্তিদানও নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন। আর আজ তাঁহার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্র নির্বিশেষে বশংবদ তোতাপাখি বানাইবার কর্মশালা চলিতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement