এক সমীক্ষা জানাইয়াছে, গুরুগ্রাম ও ফরিদাবাদে গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানায় প্রতি বৎসর প্রায় পাঁচশত শ্রমিকের আঙুল ও হাত কাটা যায়। ঘটনার ভয়াবহতায় শিহরিত হইতে হয়। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা শ্রমিকের প্রাথমিক এবং অলঙ্ঘ্য অধিকার। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ‘আইএলও’-র মতে, কর্মক্ষেত্র যদি অসুরক্ষিত হয়, তবে কাহাকেও সেইখানে কাজ করানো বাঞ্ছনীয় নহে। সেই আদর্শ পরিস্থিতির প্রস্তাব ভারতের প্রকৃত কর্মক্ষেত্রগুলিতে পরিহাসের ন্যায় শুনায়। আলোচ্য সমীক্ষায় উল্লিখিত কর্মীরা মূলত ঠিকা শ্রমিক— যাঁহাদের না আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি চালাইবার দক্ষতা, না তাঁহাদের জন্য নিয়োগকারী সংস্থা কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ঠিকাদারেরা এই শ্রমিকদের ধরিয়া আনেন, কাজে লাগাইয়া দেন। ইহা স্পষ্ট যে, শ্রমিকদের দক্ষতায় বলীয়ান করা যাঁহাদের কর্তব্য, তাঁহারা সযত্নে দায়িত্ব এড়াইতেছেন, এবং শ্রমিকরাও অরক্ষিত রহিয়া যাইতেছেন।
সঙ্কট যখন স্পষ্ট, তখন সমাধানের পথ বাহির করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা বিধেয়। প্রথমত, যে যন্ত্রে কাজ করাইবার জন্য শ্রমিককে নিয়োগ করা হইতেছে, তাহাতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিতে হইবে, যাহাতে কাজ করিতে গিয়া উপরোক্ত ঝুঁকির আশঙ্কা মোটের উপর কমাইয়া আনা যায়। উহাই বিপদ দূরীকরণের প্রধানতম উপায়। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের কাজটি যথাযথ ভাবে হইতেছে কি না, অর্থাৎ নির্দিষ্ট শ্রমিক নির্দিষ্ট যন্ত্র চালাইবার পক্ষে উপযুক্ত হইয়া উঠিতেছেন কি না, ইহা বুঝিয়া লওয়ার জন্য নজরদারি ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে হইবে। বুঝিতে হইবে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিককে সুরক্ষা দিবার প্রধান স্তম্ভ হইল এই প্রশিক্ষণ, অতএব প্রক্রিয়াটি সর্বাঙ্গীণ ভাবে সুষ্ঠু হওয়া বিধেয়। তৃতীয়ত, এতৎসত্ত্বেও যদি শ্রমিকের কোনও বিপদ ঘটে তবে তাহাকে যথার্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। এই যাথার্থ্য নিরূপণ করা সহজ নহে। যাঁহার হাত কাটা গেল, সেই অদক্ষ শ্রমিককে তাঁহার অবশিষ্ট জীবনটি সম্ভবত চাকুরিবিহীন ভাবেই কাটাইতে হইবে— সেই ক্ষতির প্রতিস্থাপনের মাত্রাটিও তদ্রূপ দীর্ঘমেয়াদি হওয়া আবশ্যক।
যদিও, এই পথে বাধা দুস্তর। অভিজ্ঞতা বলিবে, সংস্থাবিশেষে শ্রমিকের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকিলেও তাহা মিলিবার প্রক্রিয়াটি অতি ঝঞ্ঝাটপূর্ণ। কারণটি বুঝিতে অসুবিধা হয় না। পেশাগত কারণেই শ্রমিকের সামাজিক ক্ষমতা কম— ঠিকা শ্রমিকের ক্ষমতা আরও কম— অতএব তাঁহারা তেমন দর কষাকষি করিতে পারেন না, আইনি লড়াই লড়িবার ক্ষমতাও তাঁহাদের বেশি দূর নাই। এমতাবস্থায়, শ্রমিককে রক্ষাকবচ দিবার দায়িত্বটি রাষ্ট্রের। বিধিবদ্ধ ভাবে তাহাকে সুরক্ষা দেওয়া, বিপদের কালে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া— অথবা, সংস্থা যাহাতে সেই কাজ করে তজ্জন্য আইনি কাঠামো নির্মাণ করা— ইত্যাকার কর্তব্য তাহাকেই পালন করিতে হইবে। তবে, এই স্থলেও দুশ্চিন্তার কারণ আছে। বর্তমান সরকার সংসদে যে চারটি শ্রমকোড পাশ করাইয়াছে, তাহাতে পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি ও কাজের পরিস্থিতি বিষয়ক পূর্বেকার আইন বহুলাংশে লঘু হইয়াছে; ফলত, কমিতেছে শ্রমিকদের নিরাপত্তা। সরকার যদি নীতিকাঠামো তৈয়ারি না করে, তবে এই সকল সমাধানকে প্রয়োগক্ষেত্রে তুলিয়া আনা যাইবে না। শ্রমিকের হালও ফিরিবে না।