রবীন্দ্রনাথ তাঁহার শিক্ষাভাবনায় সংযোগ স্থাপনকে গুরুত্ব দিয়াছিলেন। এই সংযোগ ত্রিবিধ। প্রকৃতির সহিত সংযোগ, পড়ুয়া ও শিক্ষকের সংযোগ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহিত সমাজের সংযোগ। এই তিন প্রকার সংযোগ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ব্যাহত হইয়াছে। প্রকৃতির উদার সংযোগ হইতে শান্তিনিকেতনবাসী বঞ্চিত। কারণ, প্রতিষ্ঠানের জমি চিহ্নিতকরণের নামে স্থানে স্থানে বিচিত্র প্রাচীর নির্মাণ করা হইয়াছে। বৃহৎ টানা প্রাচীর তো বটেই, এমনকি পড়িয়া থাকা একফালি জমিতেও বিশ্বভারতীর মালিকানা প্রমাণ করিতে বহু স্থলে কুদর্শন আধখানা পাঁচিল তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। এই মানসিকতাই অন্য সংযোগ দুইটির বিনাশেরও কারণ। কর্তৃত্বের ও প্রতাপ প্রদর্শনের অন্ধ বাসনা হইতেই পড়ুয়াদের লঘু কার্যে গুরু দণ্ডের ঘোষণা। ইহা অত্যন্ত লজ্জার যে, শেষ অবধি আদালতকে হস্তক্ষেপ করিতে হইল; উপাচার্যের কর্তব্য বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করিতে হইল। এই ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সম্বন্ধে সমাজ-মানসও সঙ্গত কারণেই বিরূপ হইয়াছে। ইহা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে নানা গলদ ও দুর্নীতি প্রবেশ করিয়াছে। সেই দুর্নীতি ও বেনিয়ম দূর করিবার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সময়বিশেষে জরুরি। কিন্তু, সেই অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামরিক-শাসকদের ন্যায় কর্তৃপক্ষের আস্ফালনকে সমর্থন করা চলে না। বিশেষত, ছাত্রদের প্রতি যে অসংবেদনশীল মনোভাব তাঁহারা পোষণ করিয়াছেন, তাহা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শিক্ষাকর্তাদের ছাত্রশাসনতন্ত্রের অনুরূপ।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বহুপঠিত ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ রচনাটি আবারও স্মরণ করিতে ইচ্ছা করে। প্রেসিডেন্সি কলেজে অহমিকাপূর্ণ, দম্ভময় এক সাহেব-শিক্ষক ছাত্রদের সহিত অমানবিক ব্যবহার করিতেন। শিক্ষক-ছাত্রের স্বাভাবিক সহজ সম্পর্ক সেখানে ছিল না বলিয়া ছাত্র-আন্দোলন দানা বাঁধিয়াছিল, সেই আন্দোলনের প্রকাশ উগ্র হইয়াছিল। বস্তুতপক্ষে, বর্তমান বিশ্বভারতীতে ছাত্র-সরবতার উগ্রতার চাহিতে সেই কালের প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র-আন্দোলনের উগ্রতা কিছু বেশি বই কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সেই দিন ছাত্রদের পক্ষই গ্রহণ করিয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্রের বহিষ্কারের বিরোধিতা করিয়াছিলেন নির্দ্বিধ ভাষায়, সুযুক্তিতে। কী তাঁহার যুক্তি? তাঁহার অভিমত ষোড়শ বর্ষ উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের সহিত মিত্রের ন্যায় আচরণ করা বিধেয়। তাহাদের স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানবোধে আঘাত করা অনুচিত। রবীন্দ্রনাথ যে স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানবোধের কথা বলিয়াছেন, তাহা প্রদান করিবার জন্য শিক্ষক ছাত্র, উভয় পক্ষের মধ্যে সহজ সংস্রবের পথ খোলা রাখিতে হইবে। আর সে দায়িত্ব কর্তৃপক্ষকেই গ্রহণ করিতে হইবে। কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের জেলের কয়েদি বা ফৌজের সিপাই ভাবিলে শিক্ষাতন্ত্র ব্যর্থ হইবে। পড়ুয়ারা অপরাধীও নহে, সামরিক ছাউনির যন্ত্র-বিশেষও নহে। তাহারা নানা রকম ভাব ও আবেগের আধার। বিবেচনা ও অবিবেচনা লইয়াই পড়ুয়াজীবন। সেই অবিবেচনার আবেগকে অবদমিত করা প্রকৃত শিক্ষকের কাজ নহে— সেই অবিবেচনাকে হাসি মুখে গ্রহণ করিয়া পড়ুয়াদের সহিত সংযোগ স্থাপনই তাঁহার আদর্শ। সংযোগ স্থাপন সম্ভব হইলেই তো সেই অবিবেচনাকে মিত্রসুলভ আচরণে প্রয়োজন মতো সংশোধন করা সম্ভব হইবে। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, “কঠোর শাসনের চাপে ছাত্রেরা যদি মানবস্বভাব হইতে ভ্রষ্ট হয়, সকলপ্রকার অপমান দুর্ব্যবহার ও অযোগ্যতা যদি তারা নির্জীবভাবে নিঃশব্দে সহিয়া যায়, তবে অধিকাংশ অধ্যাপকদিগকেই তাহা অধোগতির দিকে টানিয়া লইবে।” ইহার অর্থ এমত নহে যে, রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের যথেচ্ছাচারের অধিকার প্রদান করিয়াছেন। তাঁহার অভিমত, “তারা ঠিক পথেই চলিবে, যদি তাহাদের সঙ্গে ঠিকমত ব্যবহার করা হয়।”
বর্তমান বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সহিত এই ‘ঠিকমতো ব্যবহার’ করিতে ব্যর্থ। বিদ্বেষ ও কঠিন শাসনের সম্বন্ধ কয়েদখানা ও সেনা ছাউনিতে চোখে পড়ে— ইহা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালাইবার অর্থ রবীন্দ্র-আদর্শ হইতে বিচ্যুতি। এই শাসনের সম্বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জ্ঞানকাণ্ডকেও ক্রমে ধ্বংস করিবে। মনে রাখিতে হইবে যে, জাতীয় আন্দোলনকালে উপ্ত বীজ হইতে যে উন্মুক্ত কলরবময় যাদবপুরের বর্তমান রূপ গড়িয়া উঠিয়াছে উৎকর্ষের তালিকায় সেটি শীর্ষ-স্থানীয়, কঠিন শাসনের ফলে বিশ্বভারতীর স্থান কিন্তু উৎকর্ষ তালিকায় খবর অনুযায়ী বিগত বৎসরের চাহিতে অষ্টবিংশতি ধাপ নামিয়া গিয়াছে।
যৎকিঞ্চিৎ
মানুষের প্রকৃত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কী, এই প্রশ্নের একটাই উত্তর হয়— ঈশ্বর হয়ে ওঠা। যার ক্ষমতার কোনও মর্ত-গণ্ডি নেই। প্রকৃতির সব শক্তিকে নিজের ইচ্ছেয় কাজে লাগানো হয়ে গিয়েছে; ১৯৪৫ সালের অগস্ট থেকে মারণক্ষমতায় ঈশ্বরকেও হয়তো দু’গোল দিয়ে চলেছে মানুষ। এই বার সিলিকন ভ্যালিতে তৈরি হচ্ছে অমরত্বের বটিকা— দেহের মরে যাওয়া কোষগুলোকে পুনর্জীবিত করার ব্যবস্থা। এই অমরত্ব আয়ত্ত হবে শুধু অতিধনীদেরই। অবশ্য, কবেই বা গরিবের ঘরে অমৃতভাণ্ড এসেছে?