Nehru Memorial Museum and Library

নেহরু-নামক ধারণা

বিজেপির যে নেতারা নেহরু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ম অ্যান্ড লাইব্রেরি-র নাম পাল্টে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা করে দিলেন, তাঁরা কোনও দিনই এই ভবনের দোতলায় আর্কাইভস সেকশনে বসে কোনও ফাইল দেখেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ০৫:০১
Share:

নেহরু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ম অ্যান্ড লাইব্রেরি-র নাম পাল্টে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা করা হয়েছে। —ফাইল চিত্র।

ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর পর্বের ইতিহাসচর্চার জন্য দিল্লির তিন মূর্তি ভবনের গ্রন্থাগার ও অভিলেখ্যাগারটি অপরিহার্য। সেই সংগ্রহশালায় জওহরলাল নেহরুর লেখা চিঠিপত্র, বা বিভিন্ন নথি রয়েছে বলে নয়— নেহরুর লেখার প্রায় সমস্তটাই ইতিমধ্যে সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব জওহরলাল নেহরু-র দুই সিরিজ়ে প্রকাশিত। অভিলেখ্যাগারটির গুরুত্ব এই কারণে যে, সেখানে এমন বহু মানুষের চিঠি বা লেখা রয়েছে, যা এখনও সহজলভ্য নয়। সেই তালিকায় যেমন নেহরুর প্রবল অনুরাগী-অনুগামীরা আছেন, তেমনই আছেন এমন ব্যক্তিরাও, যাঁদের সঙ্গে নেহরুর মতবিরোধ সুবিদিত। সেই তালিকায় যেমন রয়েছেন ভীমরাও রামজি আম্বেডকর বা বল্লভভাই পটেল, তেমনই আছেন মিনু মাসানি বা জয়প্রকাশ নারায়ণও। সেই সব ধূসর ফাইলের দড়ি খুলে সাবধানে পাতা ওল্টালে দেখা সম্ভব, তাঁরা যে ভারতের কথা বলছেন, তার ছবিটি নেহরু-দৃষ্ট ভারতের থেকে বিভিন্ন দিক থেকে পৃথক। সেই পার্থক্য কিন্তু নেহরুর নামাঙ্কিত এই সংগ্রহশালায় তাঁদের লেখাপত্রের স্থান হওয়ার পথে অন্তরায় হয়নি। বিজেপির যে নেতারা নেহরু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ম অ্যান্ড লাইব্রেরি-র নাম পাল্টে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা করে দিলেন, অনুমান করা চলে, তাঁরা কোনও দিনই এই ভবনের দোতলায় আর্কাইভস সেকশনে বসে কোনও ফাইল দেখেননি। অতএব, তাঁরা জানেন না যে, নেহরুর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালাটি আসলে ব্যক্তি নেহরুর নয়, নেহরু নামক ধারণাটির উদ্‌যাপন। সেই ধারণায় বিরুদ্ধ-মতের সঙ্গে যুক্তিগ্রাহ্য মতান্তর আছে, ব্যক্তি-আক্রমণ নেই; বহুত্বের প্রতি সহিষ্ণুতা আছে, একশৈলিক অন্ধতার ঠাঁই নেই।

Advertisement

বিজেপির জেহাদ অবশ্য শুধু ব্যক্তি-নেহরুর বিরুদ্ধে নয়, এই ধারণাটির বিরুদ্ধেও। খেয়াল করা ভাল, নেহরুর মন্ত্রিসভায় যেমন ভীমরাও আম্বেডকর সসম্মান স্থান পেয়েছিলেন, তেমনই গুরুত্ব পেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। অর্থাৎ, যে পরিসরটিকে নিতান্ত স্তাবক-পরিবৃত করে রাখা সম্ভব ছিল, নেহরু সেই পরিসরটিতেই নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কট্টরতম সমালোচকদের। অনুমান করা চলে, যে শাসকরা বিরুদ্ধ-স্বরের আভাসমাত্র পেলে দেশদ্রোহের মামলা ঠোকেন, তাঁদের পক্ষে নেহরুর এই অমিত আত্মবিশ্বাসকে হজম করা কঠিন। নেহরু যে বহুত্ববাদী, উদার, সহিষ্ণু ভারতের কল্পনা করেছিলেন, নাগপুর সেই ধারণাটিকে নস্যাৎ করতে চায় তো বটেই— সেই বহুত্ববাদের সঙ্গে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধ একেবারে গোড়ায়, একেবারে কাঠামোগত— কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি-নেহরুকেও ধূলিসাৎ করতে চায়। কারণ, যত ক্ষণ ব্যক্তি-নেহরুর স্মৃতিকে কালিমালিপ্ত করে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করা যায়, তত ক্ষণ অবধি তাঁর ভারত-কল্পনাকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা অসম্ভব। এই সময়টিকে খেয়াল করলেই এই প্রকল্পটির সামগ্রিক চেহারা ধরা পড়বে। এক দিকে তৈরি হচ্ছে দ্য কেরালা স্টোরি-র মতো চলচ্চিত্র, যা মিথ্যার জাল বুনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে চায়; বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের পুরস্কার— ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, অতঃপর কেবলমাত্র সরকার-অনুমোদিত বিজ্ঞান-গবেষণাই পুরস্কারের যোগ্য বিবেচিত হবে; গান্ধী শান্তি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে এমন এক প্রতিষ্ঠানকে, যার শতবার্ষিকী অস্তিত্বের প্রধানতম গুরুত্ব হিন্দুরাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্র হিসাবে। ভারতের এই চেহারাটি দেশের শাসকরা সচেতন ভাবে নির্মাণ করছেন। নেহরুর মূর্তিটি সরিয়ে দিতে পারলে এই কাজগুলি আরও প্রশ্নহীন ঔদ্ধত্যে করা সম্ভব।

নাম বদল নিয়ে বিতর্কের সম্মুখীন হয়ে বিজেপি নিক্ষেপ করেছে তাদের তূণীরের সবচেয়ে পরিচিত তিরটি— কংগ্রেসের পরিবারবাদ। নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রতি কংগ্রেসের আনুগত্য কতখানি, অথবা বিজেপির মধ্যেও পরিবারবাদ একই রকম সবল কি না, এই প্রশ্নগুলির বহু ঊর্ধ্বে অবস্থান করে একটি সত্য— জওহরলাল নেহরুকে কোনও পরিবারের মাপে বাঁধা অসম্ভব। স্বাধীন ভারতের প্রধানতম স্থপতি হিসাবেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা বিধেয়। অনুমান করা চলে, তিন মূর্তি ভবনে নেহরু-ব্যতীত অন্য যে প্রধানমন্ত্রীদের মোদী ‘গুরুত্ব’ দিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এই কথাটির সঙ্গে সমান ভাবে একমত হতেন। এমনকি, অটলবিহারী বাজপেয়ীও। কোনও দেশ, কোনও জাতির অস্তিত্ব যে পূর্বাপরহীন হতে পারে না, অতীত মহারথীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারলে যে ভবিষ্যতের সমূহ বিপদ, এই কথাটি তাঁরা জানতেন। দুর্ভাগ্য, সেই স্বাভাবিক বোধটিও আজ বিরল হয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement