রবিবার হয়ে গেল এ বছরের ‘কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক’।
Pride Walk

গর্ব

যে কোনও আন্দোলন পূর্ণতা পায় নাগরিক সমাজের সক্রিয়তায়, কলকাতায় সাম্প্রতিক কালে তেমন সক্রিয়তার উদাহরণ খুব বেশি নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৫১
Share:

প্রাইড ওয়াকে এসেছিলেন প্রায় বারো হাজার মানুষ। প্রতীকী ছবি।

রবিবারের ছুটির শহরে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবের বাঁধভাঙা ভিড় আর বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রহর গোনার মধ্যেই হয়ে গেল এ বছরের ‘কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক’। সিনেমা ও ফুটবল, বাঙালির মাতামাতির দুই উপকরণ যেখানে মজুত, সেখানে ভিন্ন যৌন পছন্দের ‘অন্য রকম’ মানুষের রাজপথে পতাকা ওড়ানো, রঙিন সাজে সেজে সগর্বে পথ হাঁটা বিশেষ উল্লেখের, কারণ প্রাইড ওয়াকে এসেছিলেন প্রায় বারো হাজার মানুষ। এলজিবিটিআইকিউ+ পরিচয়ের মানুষ তো বটেই, অন্য সহমর্মী সহনাগরিকেরাও। প্রাইড ওয়াক যখন পার্ক স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছিল, অভিবাদন জানিয়েছেন দু’ধারের রেস্তরাঁ ও খাদ্যবিপণিগুলির কর্মীরা; ওয়াকে যোগ দিয়েছেন কলকাতায় অস্ট্রেলিয়ার কনসুলেট-জেনারেল, সমাজমাধ্যমে সমর্থন জানিয়েছেন অগণিত মানুষ, বিভিন্ন দলের রাজনীতিকও।

Advertisement

প্রাইড ওয়াক নিয়ে কলকাতার এই প্রতিক্রিয়া আশা জোগায়। এই শহর ও শহরবাসীর উদারতা, জীবনের বিচিত্র দিক ও আঙ্গিককে খোলা মনে গ্রহণ করার অভ্যাস, একদা দেশে-বিদেশে সুবিদিত ছিল; তথাকথিত ‘অপর’কে জানতে ও বুঝতে চাওয়ার প্রবণতায় কলকাতা চিরকালই ছিল স্বতন্ত্র। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ কারণেই ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম প্রাইড ওয়াক হয়েছিল এই শহরেই, এমনকি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ারও সেটি প্রথম প্রাইড ওয়াক। ১৯৬৯-এর জুনে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে ‘স্টোনওয়াল ইন’-এ সমকামীদের উপর পুলিশি ধরপাকড়, হিংসা ও অত্যাচারের প্রতিবাদে পরের বছর আমেরিকার নানা শহরে শুরু হওয়া প্রাইড ওয়াক এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল: অধিকারের আন্দোলন— ভালবাসার অধিকার, ব্যক্তিগত রুচির ভিন্নতা পালনের অধিকার, এবং সেই ভিন্নতাকে বিভেদ-বিদ্বেষের দৃষ্টিতে না দেখে সমাজের বৈচিত্র ও বহুত্বে অঙ্গীভূত করতে পারার অধিকার। বহু ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও আমেরিকায় এই অধিকার আন্দোলনের পথ ভারতের তুলনায় মসৃণ হয়েছে, কারণ সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার আবহটি বেশি সুরক্ষিত। অন্য দিকে, ভারতে সমকামীদের অধিকার আন্দোলনকে লড়তে হয়েছে সমাজের বিদ্রুপ, উপেক্ষা ও হুমকির পাশাপাশি ৩৭৭ ধারা নিয়ে আইন ও বিচারব্যবস্থার দোলাচলের সঙ্গেও। এত কিছুর পরেও গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের ছোটবড় শহরে প্রাইড ওয়াক হচ্ছে, জুনে পালিত হচ্ছে প্রাইড মাস, বছরভর নানা কর্মসূচিতে সমাজপটে দৃশ্যমান হচ্ছেন সমকামীরা, সহনাগরিকেরা কথা বলছেন তা নিয়ে, এই সবই ইতিবাচক।

যে কোনও আন্দোলন পূর্ণতা পায় নাগরিক সমাজের সক্রিয়তায়, কলকাতায় সাম্প্রতিক কালে তেমন সক্রিয়তার উদাহরণ খুব বেশি নয়। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে গোটা কলকাতার রাজপথে নেমে আসা রাজ্য-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল, শাহিন বাগের সমর্থনে পার্ক সার্কাস ময়দানে শহরের অতন্দ্র রাত্রি জাগরণ বার্তা দিয়েছিল কেন্দ্রে শাসককে। রাজনীতিতে এখন দুর্বৃত্তায়ন বেড়েছে, কলকাতার নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী স্বর সে কারণেই স্তিমিত কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবু, এ শহরের মনের জানলা যে এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, প্রাইড ওয়াকে নাগরিক স্বতঃস্ফূর্ততা তা বুঝিয়ে দিল। যার মতো নই তার পাশেও থাকতে পারা, এক সঙ্গে পথ হাঁটতে পারা সহজ নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement