বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থব্যবস্থাই শ্লথ হয়েছে, ভারত ব্যতিক্রম নয়। প্রতীকী ছবি।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অর্থনীতির অধ্যাপক রাজ কৃষ্ণ ১৯৭৮ সালে তার আগের তিন দশকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গড় বৃদ্ধির হারের নাম দিয়েছিলেন ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’। সেই হার ছিল বছরে গড়ে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছরে যমুনার জল আরও ঘোলা হয়েছে, ভারত আর্থিক সংস্কারের চৌকাঠ পার করে প্রবেশ করেছে দ্রুত উন্নয়নশীল দুনিয়ায়। কিন্তু, ‘হিন্দু বৃদ্ধির হার’ কথাটির ভার এবং বিশেষত ধার যে বিন্দুমাত্র কমেনি, আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর, প্রসিদ্ধ অর্থশাস্ত্রী রঘুরাম রাজন বললেন যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এখন অতি বিপজ্জনক ভাবে হিন্দু বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি রয়েছে। কথাটি বলামাত্র বিতর্ক শুরু হল। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মহল থেকে যুক্তি এল যে, রাজন যা বলছেন, তার ভিত্তি নেই। যেমন, কোভিডের বছরে অর্থব্যবস্থায় ধস নামায় পরের বছর লো বেস এফেক্ট-এর কারণে আর্থিক বৃদ্ধির হার চড়া ছিল, ফলে স্বভাবতই এ বছরের বৃদ্ধির হার তার তুলনায় কম; বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থব্যবস্থাই শ্লথ হয়েছে, ভারত ব্যতিক্রম নয়; সর্বোপরি, ভারতের বৃদ্ধির হার অতিমারির বছর ছাড়া আদৌ ৪ শতাংশের নীচে নামেনি। যুক্তিগুলির কোনওটাই টেকসই নয়। কিন্তু, সে কথা পরে। প্রথমে ভাবা দরকার, ‘হিন্দু বৃদ্ধির হার’ বলতে রাজন ঠিক কী বুঝিয়েছেন? সম্ভবত এটাই যে, একটি অপেক্ষাকৃত নিম্ন স্তরের সাম্যাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। সেই নিম্ন স্তরটিকে যে রাজ কৃষ্ণ-বর্ণিত ৪ শতাংশই হতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই— গত দু’দশকের পরিপ্রেক্ষিতে যে বৃদ্ধির হারকে অপেক্ষাকৃত ‘নিম্ন’ মনে হতে পারে, বিপদ সম্ভবত সে বিন্দুতেই ঘনাচ্ছে।
কোভিডের ফলে তৈরি হওয়া ‘লো বেস’-এর উপরে অর্জিত বৃদ্ধির হারের সঙ্গে যদি পরের বছর পাল্লা দেওয়া না যায়, তা হলে অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যোদ্ধার বিষয়ে সরকারি ঢক্কানিনাদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, ভারতে এখন যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে, তার চরিত্র কী? পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে, মূলত সরকারি মূলধনি ব্যয় বৃদ্ধিই বর্তমান আর্থিক বৃদ্ধির মূল চালক। এবং, সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে ভারতের জিডিপি-র বৃহত্তম ভাগ, ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ে। তার কারণ স্পষ্ট— অতিমারির আগে থেকেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল, এখন বেকারত্ব বা আয়হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতির জোড়া ধাক্কায় তা ধরাশায়ী হয়েছে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয় কমায় বাজারে চাহিদাও কমেছে, তার পরিণতি বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির শ্লথগতি। এই দুই প্রবণতাতেই লুকিয়ে আছে অদূর ভবিষ্যতে নিম্ন স্তরের সাম্যাবস্থায় আটকে পড়ার বিপদ। অন্য দেশেও বৃদ্ধির হার কমছে, এই তুলনা দিয়ে ভারতের বিপদকে লঘু করে দেখানো মানে বালিতে মুখ গোঁজা।
ভারতের আশঙ্কার আরও একটি কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি। মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পরানোর উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। তাতে মূল্যস্ফীতির বিশেষ সুরাহা হয়নি— যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, তা অতিরিক্ত চাহিদার কারণে নয়, জোগানের ঘাটতির ফলে, অতএব কঠোর মুদ্রানীতি তাকে সামলাতে ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু, সুদের হার বাড়ায় যে-হেতু লগ্নির পুঁজি মহার্ঘতর হয়, ফলে নিম্ন চাহিদার অর্থব্যবস্থায় লগ্নির প্রবণতা তাতে আরও কমে। তার ফলে টান পড়ে কর্মসংস্থানে। এবং, তাতে বাজারে চাহিদা আরও কমে। এই বিষচক্র এক বার তৈরি হলে তাকে ভাঙা অতি কঠিন কাজ। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পরিচালকরা প্রবল উৎসাহে সেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করছেন। রাজন সেই বিপদের দিকেই নির্দেশ করেছেন। তাঁর কথায় গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। মনে রাখা ভাল, অতিমারির আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গের সূচনা হয়েছিল, পরিচালকদের অপরিণামদর্শিতার ফলে। অতএব, বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কান দিলে ভাল।