সামনের বছর ভারতের বৃদ্ধির হারই দুনিয়ার সর্বোচ্চ হলেও সেই হার দাঁড়াবে ৬ শতাংশের কাছেপিঠে। প্রতীকী ছবি।
আগামী অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারই সম্ভবত দুনিয়ায় সর্বোচ্চ হবে। অবশ্য তার কতখানি ভারতের কৃতিত্ব, আর কতখানি বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার উপরে জমে থাকা কালো মেঘের প্রতিফলন, সেই প্রশ্ন থাকছে। এ বছর ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস একাধিক বার ছাঁটতে হয়েছে। তার পরও অনুমান, বৃদ্ধির হার থাকবে ৬.৯ শতাংশের কাছাকাছি। সামনের বছর ভারতের বৃদ্ধির হারই দুনিয়ার সর্বোচ্চ হলেও সেই হার দাঁড়াবে ৬ শতাংশের কাছেপিঠে। এ বছর অর্থব্যবস্থার উপরে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আঁচ বিলক্ষণ পড়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়ে থাকা পণ্য মূল্য, জোগানশৃঙ্খলে ব্যাঘাত, সবই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারে ছাপ ফেলেছে। এ বছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বৈশ্বিক লড়াই চলল— ভারতেও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়াল অনেকখানি। ব্যাঙ্কের প্রধানতম লক্ষ্য যে মূল্যস্ফীতির হারকে সহনসীমার মধ্যে রাখা, এই কথা মনে করানোর পরও অবশ্য বছরভর তা থাকল ব্যাঙ্কের ধার্য সীমার ঊর্ধ্বেই। তবে, বছরের শেষে এসে মূল্যস্ফীতির হার খানিক নিম্নমুখী। আশা, মূল্যস্ফীতির লাগাম ব্যাঙ্কের হাতে ধরা থাকলে আর্থিক নীতি ফের খানিক নমনীয় হবে। বৃদ্ধির স্বার্থেই সেই নমনীয়তা প্রয়োজন।
অন্য যে সমস্যাটি ভারতকে বছরভর ব্যতিব্যস্ত রাখল, তা বেকারত্ব। সর্বভারতীয় গড় থাকল ৮ শতাংশের আশপাশে। এই কর্মসংস্থানহীনতার একটি বড় কারণ গ্রামীণ অ-কৃষি ক্ষেত্রে, বিশেষত দিনমজুরির ক্ষেত্রে, কাজের অভাব। কোভিড-পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে যে অসমতা লক্ষ করা গিয়েছে, গ্রামীণ কর্মসংস্থানে স্পষ্টতই তার প্রভাব পড়েছে। লক্ষণীয় যে, এই বছরের বাজেটে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার বরাদ্দ বাড়েনি। অর্থাৎ, বেসরকারি অ-কৃষি ক্ষেত্রে কাজের জোগান কম থাকলে সেই ঘাটতি পূরণ করার উপায়টি এ বছর সীমিত ছিল। এবং, শুধু কর্মসংস্থানহীনতার হার দেখাই যথেষ্ট নয়— কারণ, সেই অনুপাত শুধু দেখায় যে, কোনও নির্দিষ্ট সময়কালে যত মানুষ কাজ খুঁজছেন, তাঁদের মধ্যে কত শতাংশের কাজ জোটেনি। কর্মক্ষম বয়সের পরিধিতে থাকা জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ কাজ খুঁজছেন। এ বছর একাধিক মাসে এই অনুপাতটি কমেছে। অর্থাৎ, কিছু মানুষ কাজ খোঁজাই বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের পক্ষে তা সুসংবাদ নয়।
২০১৯-২০’র তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে সরকারি ভোগব্যয়ের হ্রাসের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ। জিডিপি-র অঙ্কে সরকারি ব্যয়ের গুরুত্ব তুলনায় কম— জিডিপি-র দশ শতাংশের কাছাকাছি অংশ আসে সরকারি ভোগব্যয় থেকে। কিন্তু, এর অন্য তাৎপর্য রয়েছে— সরকারি ব্যয় বাড়লে বিশেষত দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগব্যয় বাড়ে। যখন কর্মসংস্থানের ছবিটি উজ্জ্বল নয়, তখন এই ব্যয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভোগব্যয় বাড়লে এক দিকে তাদের সুরাহা হয়, অন্য দিকে জিডিপি-ও বাড়ে। ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩, এই তিন বছরে কনজ়িউমার এক্সপেন্ডিচার বা বেসরকারি ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১১.২ শতাংশ। আগের তিন বছরে যা প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছিল। এ বছর উদ্বেগ বাড়াচ্ছে আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রও। গত বছর পণ্য ও পরিষেবা, উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের রফতানি রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছিল। এ বছর তাতে ঘাটতি পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার পড়তি দাম এবং পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভারতের আমদানি ব্যয়ও বাড়িয়েছে অনেকখানি, ফলে চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণ উদ্বেগজনক স্তরে পৌঁছচ্ছে। তবে, বছরের শেষে দাঁড়িয়ে যদি একটি ইতিবাচক কথা বলতে হয়, তা এই রকম: এই বছর কেন্দ্রীয় সরকার অর্থব্যবস্থার পক্ষে ভয়ঙ্কর কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। আট বছরের অভিজ্ঞতায় এমন বছর খুব একটা আসেনি, তা উল্লেখ করা ভাল।