প্রতীকী ছবি।
ডিজিটাল যুগে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগণ্য দেশগুলির একটি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে ভারতের, কথাটি আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দিলেন ভারতের ভূতপূর্ব মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অধ্যাপক কৌশিক বসু। তবে, তার জন্য শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ জরুরি, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। অধ্যাপক বসু ধারাবাহিক ভাবেই এই কথাটি বলে আসছেন। তাঁর কথার সূত্র ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সময়ের আমেরিকা ও আর্জেন্টিনার তুলনা করা চলে। তখন আর্জেন্টিনার অর্থব্যবস্থা অতি দ্রুত উন্নতি করছিল, যা কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার চেয়েও উল্লেখযোগ্য ছিল। মনে করা হচ্ছিল যে, বিশ্বের অগ্রগণ্য অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চলেছে দেশটি। কিন্তু, পরবর্তী দু’তিন দশকে ক্রমশ এগিয়ে গেল আমেরিকা, পিছিয়ে পড়ল আর্জেন্টিনা। অর্থনীতির ইতিহাস বলছে, কারণটি স্পষ্ট— আমেরিকা শিক্ষায়, গবেষণায় লগ্নি করার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিল, আর্জেন্টিনা করেনি। সাম্প্রতিকতর উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। গত শতকের ষাটের দশক অবধি ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক অবস্থা তুলনীয় ছিল। ১৯৬১ সালে দুই দেশে মাথাপিছু আয় ছিল বছরে যথাক্রমে ৮৫ ডলার ও ৯৪ ডলার। ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ভারতের ১৬ গুণের বেশি। বলা যেতে পারে, দু’দেশের আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে এতখানি তফাতের পিছনে অন্যতম বড় ভূমিকা হল শিক্ষার প্রতি গুরুত্বের তারতম্যের। দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি পেটেন্টের মালিক দক্ষিণ কোরিয়া— দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি দশ লক্ষ নাগরিক পিছু পেটেন্টের সংখ্যা ৩৩১৯টি; জাপানে এই সংখ্যা ১৯৪৩। কিছু দিনের মধ্যেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অঙ্কে জাপানকে টপকে যাবে দক্ষিণ কোরিয়া। রাষ্ট্রনীতি শিক্ষাকে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে, তার উপর দেশের আর্থিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে অনেকখানি।
কৃত্রিম মেধা ও রোবটিক্স-এর যুগে কাজের চরিত্র পাল্টাতে চলেছে, সে কথা স্পষ্ট। এই পর্বান্তরকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। অর্থনীতির ইতিহাস সাক্ষী, শিল্পবিপ্লবের প্রতিটি পর্যায়েই উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোনও না কোনও ধাপে মনুষ্যশ্রমের পরিবর্তে যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে যে, ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে উন্নত দেশগুলিতে জিডিপি-তে শ্রমিকদের মজুরির অনুপাত ক্রমে কমতে আরম্ভ করে। ঘটনা হল, ভারতের মতো দেশে মজুরির হার এতই কম যে, হয়তো আগামী কিছু বছর এখানে যন্ত্র এসে মানুষের কাজ দখল করবে না। কিন্তু, এমন একটা সময় আসবে, যখন ভারতেও যন্ত্রই বেশির ভাগ প্রথাগত এবং যান্ত্রিক কাজ করবে। অতএব, ভবিষ্যতে আমাদের এমন কাজের জন্য তৈরি হতে হবে, যে কাজ কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে সহজে করা যাবে না। তার জন্য শিক্ষার চরিত্র পাল্টাতে হবে, প্রচলিত মুখস্থবিদ্যার বাইরে তাকে সৃষ্টিশীল করে তুলতে হবে।
তার জন্য যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রয়োজন, তেমনই চাই ক্ষেত্রটিকে বিশ্বমানের করে তোলার সদিচ্ছা। ফের দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টানা প্রয়োজন— সে দেশে শিক্ষকদের বেতন রীতিমতো আকর্ষণীয়, ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সাগ্রহে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। তার সুপ্রভাব পরিবাহিত হয় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে। তার বিপরীতে রাখা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতিকে। যোগ্যতার বদলে যদি টাকা দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি কেনা যায়, তবে তাতে বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যক্ষ ক্ষতি— অযোগ্য শিক্ষকের পক্ষে উন্নত শিক্ষাদান করা অসম্ভব। সেই শিক্ষকের কাছে যারা লেখাপড়া শিখবে, আশঙ্কা হয়, তাদের সিংহভাগই ভবিষ্যতে কর্মী হিসাবে অযোগ্য হবে, শিক্ষক হিসাবেও। ক্ষুদ্র স্বার্থ কী ভাবে ভবিষ্যতের পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে, এ তার এক অতি বাস্তব ভয়ঙ্কর উদাহরণ।