—ফাইল চিত্র।
অন্তর্বর্তী বাজেট কিংবা ভোট অন অ্যাকাউন্ট, যে নামেই ডাকা হোক, নির্বাচনী বছরের আয়ব্যয়ের হিসাব পেশ করতে গিয়ে বিদায়ী সরকার নতুন কোনও নীতি বা উদ্যোগ করতে তৎপর হবে না— এই অলিখিত রীতির মাপকাঠিতে বিচার করলে নির্মলা সীতারামনের ষষ্ঠ বাজেটটি মোটের উপর ব্যাকরণসম্মত, তিনি নতুন প্রায় কিছুই করেননি। এই সংযম নিয়ে তিনি নিজে বেশ গর্বও প্রকাশ করেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর একটি বিশেষ ঘোষণা কিঞ্চিৎ চমকপ্রদ মনে হতে পারে। বাজেট বক্তৃতায় তিনি জানিয়েছেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জনবিন্যাসের কাঠামোয় পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করা হবে। স্বাভাবিক বুদ্ধি এই প্রশ্ন তুলবেই যে, জনসংখ্যা বা তার বিন্যাস তো এক দিনের ব্যাপার নয়, দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্ন। এমন বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য শেষ প্রহরে কেন এমন কমিটি বসাতে হবে? নির্বাচনের পরে— ক্ষমতায় ফিরলে— যা করার করলে চলত না?
সহজ উত্তর: চলত না। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। বস্তুত, স্বাভাবিক এবং বাস্তবসম্মত বিবেচনা বলে যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা তার বিন্যাস নিয়ে কমিটি বসানো দূরস্থান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আজ আর আলাদা করে ভাববারও কিছু নেই। প্রথমত, দেশের কিছু অংশ, বিশেষত উত্তর ভারতের তথাকথিত হিন্দি বলয়ের কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইতিমধ্যেই প্রশমিত, কোথাও কোথাও জনসংখ্যা কার্যত স্থিতিশীল, কোনও কোনও অঞ্চলে নিম্নগামী। দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট এলাকাগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করতে হবে, সেটাও অত্যন্ত স্পষ্ট। শিক্ষা, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার যথার্থ প্রসার এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি নিশ্চিত করতে পারলে জন্মহার কমে আসে, কেবল ভারতের বহু রাজ্যে নয়, দুনিয়া জুড়েই এই সত্য নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যতেও এই কার্যকারণসূত্রটি সমান সত্য। আর, এ দেশে জনবিন্যাসের গতিপ্রকৃতি এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে, তাতে বিপুল সংখ্যক তরুণতরুণীর শিক্ষা ও কাজের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করাই প্রকৃত সমস্যা, তার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন ‘কোটি কোটি কর্মসংস্থান’ কিংবা ‘লাখপতি দিদি’ গোছের অবান্তর জুমলা বা ফানুস ওড়ানো বন্ধ করে যথাযথ আর্থিক নীতি রচনা ও রূপায়ণ। সেই দরকারি কাজগুলি ছেড়ে কমিটি বসানোর এই তৎপরতা কেন?
এই সংশয়ের প্রবল কারণ আছে যে, কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য কমিটি বসানোর পরিকল্পনা করা হয়নি, বাজেট বক্তৃতায় এই ঘোষণাটি ছুড়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনী রাজনীতির জল ঘোলা করার গূঢ় উদ্দেশ্যে। বর্তমান শাসকদের শিবির থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচার করা হয়ে আসছে যে, ভারতে জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত কমে আসছে, এই ‘বিপদ’ থেকে বাঁচতে হলে জন্মনিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট কঠোর নীতি চাই। কারা এই কঠোরতার প্রকৃত লক্ষ্য, সে কথা অনুমান করার জন্য কোনও বিশেষ বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। বাস্তব পরিসংখ্যান এই প্রচারকে একেবারেই সমর্থন করে না। সত্য এই যে, দেশের সমস্ত বর্গের মানুষের মধ্যেই জন্মহার কমছে, যেখানে তা এখনও বেশি সেখানেও সমস্ত বর্গের ক্ষেত্রেই বেশি। এবং, হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার কোনও প্রশ্নই নেই, বস্তুত জনবিন্যাসের আপেক্ষিক অনুপাতগুলি মোটের উপর স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তথ্য বা সত্য নিয়ে প্রচারকদের মাথাব্যথা নেই, তাঁরা জনসংখ্যা এবং তার বিন্যাসকে জুজু হিসাবে ব্যবহার করতে ব্যগ্র, যে জুজু দেখে হিন্দুরা ভয় পেয়ে তাঁদের ভোট দেবেন। সেই কারণেই ভোটের আগে কমিটি গড়ার এত তাড়া। কমিটি কোনও কাজ করবে কি না, এমনকি তা যথাযথ ভাবে গড়া হবে কি না, সেই প্রশ্ন গৌণ। নির্বাচনী জিগির তোলাই প্রকৃত লক্ষ্য। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তার উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।