Society

বিদ্বেষবিষ

সমাজের মানসিকতাকে গরলমুক্ত না করতে পারলে এই বিদ্বেষের অভিযান প্রতিহত করা যাবে না। সেই কাজ সমস্ত সচেতন নাগরিকের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৪০
Share:

ভারতে ধর্মপরিচয়ের কারণে কোভিডের সময় সবচেয়ে বেশি বাড়তি যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। প্রতীকী ছবি।

কোভিড অতিমারির প্রথম পর্বে এ-কথা বহুলপ্রচলিত হয়েছিল যে, মারণ-ভাইরাসের কাছে সবাই সমান, সে মানুষের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা(ন) বিচার করে না। কথাটা এক অর্থে সত্য। কিন্তু সেই অর্থ অতি সীমিত। গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, বিভিন্ন মানুষের উপর অতিমারির প্রকোপ বিভিন্ন মাত্রার। আর্থিক অবস্থা, সামাজিক পরিবেশ, সরকারি নীতি ও উদ্যোগ, বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী এবং নাগরিকের মানসিকতা ও আচরণ— বহু দিক থেকে সেই বিভিন্নতার প্রকাশ ঘটেছে। ভাইরাসের ভেদবুদ্ধি নেই, কিন্তু মানুষের আছে, আর তার ফলে অতিমারির অভিজ্ঞতাতেও নানা ধরনের তারতম্য ঘটেছে। তেমনই এক ধরনের ভেদাভেদের তথ্য-পরিসংখ্যান জানিয়েছে পিউ রিসার্চ সেন্টার। আমেরিকার সমীক্ষক সংস্থাটি ১৯৮টি দেশে অনুসন্ধান করে দেখেছে, ২০২০ সালে কোভিডের সঙ্গে জড়িত বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে কোথায় কতটা বৈষম্য বা অন্যায় করা হয়েছে। এই ধর্মপরিচয়-ভিত্তিক ‘সামাজিক বিদ্বেষের সূচক’ অনুসারে ক্রমাঙ্কনের ভিত্তিতে যে তালিকাটি রচিত হয়েছে, সেখানে ভারতের স্থান সবার ‘উপরে’। অর্থাৎ, দুনিয়ার মধ্যে এই দেশেই ধর্মপরিচয়ের কারণে কোভিডের সময় সবচেয়ে বেশি বাড়তি যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।

Advertisement

সূচকের সত্যমূল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু কয়েক বছর ধরে ধর্মাশ্রিত বৈষম্য, নিপীড়ন ও বিদ্বেষের যে অজস্র ঘটনা ভারতে ঘটে চলেছে, তার সঙ্গে এই সমীক্ষা রিপোর্টের সামগ্রিক সঙ্কেতটি রীতিমতো মানানসই। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের তাগিদে সামাজিক মেরুকরণের অভিযানে ধর্মীয় পরিচয়কে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার অতিপরিচিত অপকৌশলই প্রকট হয়েছে অতিমারির সময়েও। পিউ রিসার্চ সেন্টারের রিপোর্টে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে অতিমারির সূচনাকালে দিল্লিতে তবলিগি জামাত নামক ধর্মীয় সমাবেশের কাহিনি। এই সমাবেশকে ‘করোনা সংক্রমণের বড় উৎস’ হিসাবে অভিহিত করার মধ্য দিয়ে কী ভাবে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ প্রচারিত হয়েছিল, যে কোনও সচেতন নাগরিক তা বিলক্ষণ জানেন। অথচ, প্রায় একই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর উপলক্ষে আমদাবাদে বিপুল জনসমাগম ‘সংগঠিত’ হয়েছিল, তবলিগি জামাতের উচ্চকণ্ঠ বিরোধীরা মুখে রা কাড়েনি! দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন বৈষম্যের ছোট বড় নানা দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় তারই প্রতিফলন।

সমীক্ষায় দৃষ্টিপাত করা হয়েছে ‘সামাজিক’ বিদ্বেষের উপর। বিদ্বেষ এবং বিভাজনের মানসিকতা যখন সামাজিক বোধের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়, নাগরিকদের এক বড় অংশ যখন ‘অপর’-এর প্রতি বিদ্বেষ বা বিরাগকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেন, তখন বুঝতে হয় যে প্রকৃত সমাজধর্মের ভিত্তিমূলে বড় রকমের ফাটল ধরেছে। তখন আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও ‘আমরা-ওরা’র ছকেই দুনিয়াকে দেখতে অভ্যস্ত হন। সেই অভ্যাস যুক্তিবোধকে আচ্ছন্ন করে, তার সুযোগ নিয়ে অ-সত্য এবং অপসত্যের কারবারিরা সমাজমাধ্যমে ও অন্য পরিসরে তাদের কুৎসিত ও ভয়ানক বিদ্বেষের প্রচারে সফল হয়। সমীক্ষায় সমাজমাধ্যমের বিষাক্ত ভূমিকার কথা বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি কলকাতায় এক আলোচনাসভায় সত্যান্বেষী সাংবাদিকরা নির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত সহযোগে জানিয়েছেন, কী ভাবে একটি কাগজের টুকরো ফেলবার দৃশ্য কোভিড সংক্রমণের ষড়যন্ত্রের ‘প্রমাণ’ হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল, বহু লোক সেই প্রচারকে সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। স্পষ্টতই, সমাজের মানসিকতাকে গরলমুক্ত না করতে পারলে এই বিদ্বেষের অভিযান প্রতিহত করা যাবে না। সেই কাজ সমস্ত সচেতন নাগরিকের।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement