—প্রতীকী ছবি।
এক মহিলা অর্থমন্ত্রী যখন বাজেট-বক্তৃতায় ঘোষণা করেন যে মহিলাদের জন্য তিন লক্ষ কোটি টাকা ধার্য করেছে দেশ, তখন আশা জাগে বইকি। এ বছরের আর্থিক সমীক্ষাও দাবি করেছে, ‘নারী উন্নয়ন’ থেকে ‘নারী-নেতৃত্বে উন্নয়ন’-এর দিকে চলেছে ভারত। সরকারের হিসাবে কতটা দুধ আর কতটা জল— অর্থাৎ বাজেট-লিখিয়েদের হাতসাফাইয়ে কত টাকা এক তালিকা থেকে অন্য তালিকায় গিয়ে বরাদ্দের অঙ্ককে বড় করে দেখাচ্ছে— তার বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে মেয়েদের জন্য বরাদ্দকে বাড়ানো, বা বড় করে দেখানো, যে নেতাদের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছে, সে কথাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যে সমালোচনাটি বিশেষ তীব্র হয়েছে, তা হল কর্মক্ষেত্রে যোগদানের নিরিখে ভারতের মেয়েদের পশ্চাৎপদতা। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে যেখানে আরও বেশি মেয়ে কাজের জগতে যোগ দিচ্ছে, সেখানে ভারতে মেয়েদের কর্মনিযুক্তি কমছে, তারা আটকে থাকছে বেতনহীন গৃহশ্রমে। এই সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁর বাজেট-বক্তৃতায় বললেন, সরকার কথা বলবে শিল্পপতিদের সঙ্গে, যাতে যৌথ উদ্যোগে মেয়েদের জন্য হস্টেল, শিশুদের ক্রেশ তৈরি হয়। মেয়েদের উপযোগী প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে যৌথ উদ্যোগে। অর্থাৎ, শ্রমজীবী মেয়েদের জরুরি প্রয়োজনগুলির কোনওটার ব্যয়ভার কেন্দ্র একক ভাবে বহন করতে রাজি নয়। শিল্পক্ষেত্র যেখানে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার (বেতন, চিকিৎসা, পিএফ-পেনশন) সুরক্ষাতেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছে, সেখানে মেয়েদের বিশেষ চাহিদা পূরণে কতটুকু আগ্রহী হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কেন্দ্র এ বছর বাজেটে নারী উন্নয়ন বা সুরক্ষার কোনও নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেনি। তাই কৌতূহল জাগতে বাধ্য, এতগুলো বাড়তি টাকা তা হলে কোন খাতে বরাদ্দ হল? কেন্দ্রের প্রকাশিত ‘জেন্ডার বাজেট স্টেটমেন্ট’ থেকে প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি খাতে বরাদ্দ গত অর্থবর্ষে জেন্ডার বাজেটের অধীনে আনা হয়নি, যা এ বার হয়েছে। ফলে সেই সব খাতে মোট বরাদ্দ না বাড়লেও, বা সামান্য বাড়লেও, জেন্ডার বাজেটের আয়তন বেড়ে গিয়েছে। যেমন ছাদের উপর সৌরবিদ্যুতের সরঞ্জামের জন্য বরাদ্দের একাংশ (৪৫৫৫ কোটি টাকা), বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি প্রকল্পের বরাদ্দের একাংশ (৩৯৭৬ কোটি টাকা) গত বছর জেন্ডার বাজেটে ছিল না, এ বার এসেছে। আবার জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন, বা ‘আজীবিকা’-র একাংশ (৭০৬৪ কোটি টাকা) গত বার দেখানো হয়েছিল জেন্ডার বাজেটে, এ বার তার সম্পূর্ণ বরাদ্দই (১৫,০৪৭ কোটি টাকা) দেখানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী-কথিত তিন লক্ষ কোটি টাকার কতটা কেবল শিরোনামের লেবেল বদল করে এ বছর জেন্ডার বাজেট বিবৃতিতে ঢুকল, আর কত টাকা বাস্তবিকই নতুন প্রাপ্তি, তার হিসাব কষতে হবে দেশবাসীকে। প্রতি বার বাজেটের পর সেই ছক্কা-ফক্কার খেলা চলে সামাজিক ক্ষেত্রের বরাদ্দ নিয়ে।
নির্ভয়া তহবিলের খরচ নিয়ে সরকারের দাবি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনও অবধি বরাদ্দ টাকার সত্তর শতাংশই খরচ হয়ে গিয়েছে। খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়, সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের অধিকাংশই (প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা) খরচ হয়েছে কেবল আটটি মহানগরে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, মহিলাদের হেল্পলাইন, ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম তৈরির জন্য ধার্য টাকা অধিকাংশ রাজ্যই যথাযথ ভাবে খরচ করতে পারেনি। বরং বরাদ্দ খরচ হয়েছে অন্য খাতে— মহারাষ্ট্রে ওই টাকায় পুলিশ ভিআইপি সুরক্ষার গাড়ি কিনেছে। কেন্দ্রের কার্পণ্য, রাজ্যগুলির অবহেলা এবং সার্বিক নজরদারির অভাব— এ সবের ফলে বিপুল বরাদ্দ সত্ত্বেও মেয়েদের সুরক্ষা পরিকাঠামোর দুর্দশা ঘোচেনি। ২০১২-র চাইতে আজকের ভারতে মেয়েরা অধিক সুরক্ষিত, তারা আরও দ্রুত বিচার পায়, এমন দাবি করা চলে না। টাকার অঙ্কের আস্ফালন নয়, যথাসময়ে যথাযথ খরচই উন্নয়নের দিশা।