PM Narendra Modi

ভোটের হাটে পরমাত্মা

নিজের ভাবমূর্তিকে ক্রমাগত উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে তুলে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর আচরণে বহু দিন যাবৎ প্রকট। এক অর্থে ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের প্রকরণ হিসাবে তাঁর ‘হলোগ্রাম’টি ছিল সেই কৌশলের অগ্রদূত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ ০৮:১১
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

যা অসম্ভব, অলীক, উদ্ভট, অম্লানবদনে তেমন কথা ভাবতে, বলতে বা লিখতে পারার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে হাস্যরস তথা কৌতুকের অফুরন্ত সম্ভার। এই সারসত্যটিকে কাজে লাগিয়ে বহু কাল ধরে বহু অবিস্মরণীয় কাহিনি ও চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছে। যথা, বিরিঞ্চিবাবা। পরশুরামের পাঠক এবং সত্যজিৎ রায়ের দর্শক জানেন, নিজেকে নিয়ে অনর্গল আজগুবি গল্প বলে যাওয়ার ক্ষমতাতেই নিহিত ছিল সেই মহাপুরুষের চরিত্রটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, যা তাঁর সান্ধ্য আসরে সমাগত ‘ভক্ত’দের আপ্লুত করে তুলত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী দিনকয়েক আগে নিজের সম্পর্কে— অম্লানবদনেই— যে গোপন খবরটি ফাঁস করেছেন, তা শুনলে বিরিঞ্চিবাবারও পিলে চমকে যেত। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির প্রশ্নের উত্তরে শ্রীযুক্ত মোদী জানিয়েছেন যে, মাতৃবিয়োগের পরবর্তী কালে নিজের কর্মকাণ্ড ভাল করে দেখেশুনে তিনি ইদানীং এই বিষয়ে ‘নিশ্চিত’ হয়েছেন যে, সাধারণ মনুষ্যজন্মের নিয়মকানুন দিয়ে তাঁর আবির্ভাবকে ব্যাখ্যা করা যাবে না, ‘পরমাত্মা’ই আপন অভিপ্রেত কাজ করে যাওয়ার জন্য তাঁকে ধরাধামে পাঠিয়েছেন। এবং, ২০৪৭ সাল অবধি সেই কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি বিরাজমান থাকবেন। প্রসঙ্গত, তখন তাঁর জৈব শরীরের বয়স হবে ৯৬ বছর। পরমাত্মার অবশ্য বয়সের ঝঞ্ঝাট নেই।

Advertisement

মুশকিল হল, নরেন্দ্র মোদী বিরিঞ্চিবাবা নন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। গল্পের ভণ্ড সন্ন্যাসী লোক ঠকানোর জন্য আগডুম-বাগডুম বললে হাস্যরসের সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেকে পরমাত্মার প্রেরিত অ-লৌকিক প্রাণী বলে দাবি জানালে সুস্থবুদ্ধি এবং শুভবোধ সম্পন্ন নাগরিকের মনে যে অনুভূতি জাগ্রত হয় তা কৌতুকের নয়, যুগপৎ বিবমিষা এবং উদ্বেগের। হাস্যরস নয়, তার নাম ভয়ানক রস। ভয়ানক এই কারণে যে, নরেন্দ্র মোদীর এমন অ-পার্থিব বচন শুনে তাঁর মহিমায় দ্বিগুণ অভিভূত হওয়ার মতো লোক এ দেশে বিরল নয়, বরং অতিমাত্রায় সুলভ। এবং, সম্ভবত সেই সত্যটি বিলক্ষণ জানেন বলেই তিনি আপন মহিমা কীর্তনে নতুন পদ বেঁধেছেন। এ-কথা এখন বহুচর্চিত যে, নির্বাচনপর্ব যত এগিয়েছে, তাঁর প্রচারের ভাষা ও ভঙ্গি তত বেশি উগ্র এবং আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। দিকে দিকে রব উঠেছে: ভোটের হাওয়া যথেষ্ট অনুকূল নয় বুঝেই, অর্থাৎ বেগতিক দেখেই, দলনায়ক বেপরোয়া ব্যাট চালাচ্ছেন। এখন, ভোটের শেষ পর্বে এসে তাঁর নতুন জন্মরহস্য শ্রবণ করে প্রশ্ন জাগতেই পারে: মর্তলোকের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্রে কাজ দিচ্ছে না ভেবে এ-বার কি তা হলে পরমাত্মাকেও প্রচারে নামাতে হল?

নিজের ভাবমূর্তিকে ক্রমাগত উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে তুলে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর আচরণে বহু দিন যাবৎ প্রকট। এক অর্থে ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের প্রকরণ হিসাবে তাঁর ‘হলোগ্রাম’টি ছিল সেই কৌশলের অগ্রদূত। তার পর এক দশক ধরে দল এবং সরকারের সমস্ত অপদার্থতা, সব দুঃশাসনকে এক দিকে অস্বীকার করে এবং অন্য দিকে তার দায়দায়িত্ব অন্যদের উপর চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিমাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখার প্রকল্পটি অব্যাহত থেকেছে। এখন, দশ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রতিমার খড় মাটি উত্তরোত্তর বেরিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তাগিদ যদি তাড়নায় পরিণত হয়ে থাকে, বিস্ময়ের কিছু নেই। ঠিক সেই কারণেই এই আপাত-উদ্ভট কথামালাকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, অর্থহীন প্রলাপ বলে এড়িয়ে গেলেও ভুল হবে। বিপজ্জনক ভুল। গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের সুস্থ ভবিষ্যতের স্বার্থে সমস্বরে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা দরকার: প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার হতে পারে একমাত্র দেশের যথার্থ উন্নয়নের মাপকাঠিতে, কোন পরমাত্মা তাঁকে কী ভাবে এবং কোন দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তার হিসাব তিনি সেই পরমাত্মার সঙ্গে কষে নিতে পারেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তার দাম কানাকড়িও নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement