অমিত শাহ। —ফাইল চিত্র।
এক জন, পরীক্ষায় কেবল উত্তীর্ণ নয়, ডাবল প্রোমোশন। অন্য জন, ফেল; ডাবল ফেল বলে কিছু থাকলে সেটাও। নাগরিকত্ব ও ‘অনুপ্রবেশ’ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মত এ রকমই। তিনি বলে দিয়েছেন, বিজেপি শাসনে অসম রাজ্য অল্প সময়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ কমিয়ে ফেলতে পেরেছে। অন্য দিকে, তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ সমস্যা তো কমেনি বটেই, বরং ভোটার কার্ড ও আধার কার্ডের দরাজ বিতরণের ফলে আরও উৎসাহিত হয়েছে। নতুন কথা নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এই তীব্র অভিযোগ বিজেপি কর্ণধার পেশ করে চলেছেন প্রায় এক দশক ধরে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর সে বছরের ডিসেম্বরেই দক্ষতার সঙ্গে সংসদে তাঁর নেতৃত্বে পাশ করানো গিয়েছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯। তবে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের তীব্র আপত্তির কারণে সে আইন এখনও কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। মমতা-নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসই সেই উল্টো দিকের দলগুলির অন্যতম প্রধান, তাই স্বভাবতই অমিত শাহের তীব্র ক্ষোভ অভিযোগের নিনাদ হয়ে আছড়ে পড়ে মাঝেমধ্যে, বিশেষত নির্বাচনী প্রচারকালে। ২০২১ সালে তিনি এবং তাঁরা সিএএ-র বৃহত্তর প্রেক্ষিত হিসাবে সংখ্যালঘু-তোষণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন, সব ক্ষেত্রের সঙ্কটকেই। ২০২২ সালে ঘোষণা করেছিলেন, কোভিড সমস্যা পুরোপুরি মিটলেই এই রাজ্যে সিএএ চালু হবে। আবার ২০২৩ সালের শেষে ফিরে এসেছে সেই বজ্রনাদ। গত সপ্তাহে কলকাতার সভায় জনারণ্য না দেখা গেলেও নাদটি মোক্ষম ভাবে ধ্বনিত হল।
যে রাজ্যের এক দিক বরাবর ৪০৯৬ কিলোমিটার বাংলাদেশ সীমান্ত, এবং যে রাজ্য গত সাড়ে সাত দশক ধরে প্রাত্যহিক ভিত্তিতে দেশভাগের ফল বহন করছে, সেখানে অনুপ্রবেশ যে একটি ঘোর বাস্তব— এবং একটি বিরাট সঙ্কট— এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। সমস্যা অন্যত্র। এই বাস্তবের সঙ্গে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষকে যে ভাবে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে। মুসলমানদের আলাদা করে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দাগিয়ে হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের শরণার্থী বলে ঘোষণার মধ্যে। এত দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল সমস্যার চটজলদি অমানবিক সমাধান হিসাবে শিবিরে প্রেরণ ও দেশ থেকে বহিষ্কারের দাওয়াইয়ের মধ্যে। আসলে যে একটি হীন, বিভাজনমূলক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এত বড় একটি ঐতিহাসিক বিপর্যয়কে ব্যবহার করা হচ্ছে— এ সব থেকেই তা স্পষ্ট।
কী কী তথ্য-পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে অসমের ‘সাফল্য’ দাবি করা হচ্ছে? সে রাজ্যে বহু মানুষকে ডি-ভোটার হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অনেকের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল, এ সব কথা বহুজ্ঞাত। কিন্তু এও কি সত্যি নয় যে, এর মধ্যে লাগামছাড়া বেনিয়ম চলেছে, এবং নিয়ম পালনের নামে চলছে প্রহসন? যে সব কাগজ দেখতে চাওয়া হচ্ছে, তা না দেখাতে পারায় বহু সাধারণ মানুষ অকারণে এই নাগরিকত্ব-প্যাঁচে পড়েছেন। সম্প্রতি গুয়াহাটি হাই কোর্টও এ নিয়ে জোরালো মত ব্যক্ত করেছে, ফরেনার্স ট্রাইবুনালকে সতর্ক করেছে। এমন অসংখ্য মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন যাঁদের নাগরিকত্বের দাবি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল নাকচ করলেও তাঁরা আদালতে মামলা ঠুকে জয় পেয়েছেন। ফলে একটি আইনের আবরণে যে ব্যাপ্ত অনাচার চলমান, তাকে ‘সাফল্য’ বলে প্রচার করলে বিজেপির ঢাক পিটানো হতে পারে, কিন্তু সত্যভাষণ হয় না। তবে রাজনীতির ঢাকের সঙ্গে সত্যভাষণের সম্পর্কই বা কী। দুর্ভাগ্য শুধু, অনুপ্রবেশ আটকানোর নামে সংখ্যালঘু বিদ্বেষবিষ ছড়িয়ে দলীয় স্বার্থসিদ্ধির এই প্রকল্পে যে কত সহস্র নিরপরাধ অসহায় মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। থাকবেও না।