ফাইল চিত্র।
উন্নয়ন করিতে গেলে চাই পরিবর্তন, তাহা আসিবে নূতন আইনকানুন ও প্রস্তাবিত পথ ধরিয়াই। কিন্তু লক্ষদ্বীপের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটেল যে প্রস্তাবগুলি করিয়াছেন, তাহাতে সমর্থনের সমস্বর নহে, প্রতিবাদের প্রবাহ বহিয়া যাইতেছে। প্রশাসকের প্রস্তাব, লক্ষদ্বীপে গোমাংস নিষিদ্ধ হউক, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আমিষ বন্ধ হউক। অথচ, এত কাল যাহা বন্ধ ছিল, সেই মদ বিক্রি শুরু হউক, কারণ তাহাতে পর্যটনের লাভ। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা থাকিবে মানুষের জমি অধিগ্রহণ করিবার, প্রস্তাবে তাহাও আছে। দুইয়ের বেশি সন্তান থাকিলে কেহ পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হইতে পারিবেন না, এহেন শর্তও। চালু হইতে পারে নূতন গুন্ডাদমন আইন, আছে রাস্তাগুলিকে জাতীয় সড়কের ন্যায় বাড়াইবার পরিকল্পনাও।
প্রস্তাবিত প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ঘনাইতেছে, এবং সঙ্গত কারণেই। গত বৎসর ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক লক্ষদ্বীপের প্রশাসক নিযুক্ত হইবার পর হইতেই প্রফুল্ল একের পর এক খসড়া আইন আনিয়াছেন— দ্বীপবাসীর সমর্থন বা মতামতের পরোয়া না করিয়াই। প্রাণী সংরক্ষণ আইনে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা, গোমাংস রাখিলে বা জুগাইতে গিয়া ধরা পড়িলে দীর্ঘ কারাবাসের ভয় দেখানো হইতেছে সেই ভূমিতে, যাহার বাসিন্দারা মুখ্যত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। উপকূল রক্ষা আইন দেখাইয়া ভাঙিয়া ফেলা বা সরাইয়া দেওয়া হইতেছে সেই নির্মাণগুলিকে, যুগ যুগ ধরিয়া যাহা মৎস্যজীবীদের ‘ল্যান্ডিং সেন্টার’। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনে প্রশস্ত হইতেছে দেদার জমি অধিগ্রহণের পথ, যে জমির সংবিধান-স্বীকৃত মালিক লক্ষদ্বীপের জনজাতি মানুষ। সম্ভাব্য সন্ত্রাস-সংযোগের ইঙ্গিত করিয়া গুন্ডাদমন আইন চালুর প্রস্তাব করা হইতেছে সেই মাটিতে, যাহা কার্যত অপরাধবিরল। যে দ্বীপভূমিতে রাস্তার সর্বাধিক দৈর্ঘ্য মাত্র ১১ কিলোমিটার, সেখানে জাতীয় সড়কের ন্যায় রাজপথ করিবার অর্থ কী? বিরোধী দলগুলি— বিশেষত কংগ্রেস, ও লক্ষদ্বীপের প্রতিবেশী রাজ্য কেরলে সিপিএম— অভিযোগ করিতেছে যে, ইহা লক্ষদ্বীপের উপর বিজেপির ছড়ি ঘুরাইবার, ক্ষমতা প্রদর্শনের অলজ্জ আস্ফালন। রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রশ্ন সরাইয়া রাখিয়া, শুধু লক্ষদ্বীপবাসীর দিক দিয়া বিচার করিলেও বলিতে হয়, এই সকল পদক্ষেপ জনবিরোধী, লক্ষদ্বীপের ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতিরও পরিপন্থী। প্রকৃতি, জীববৈচিত্র ও জনসংস্কৃতি, সব দিক দিয়া লক্ষদ্বীপ বরাবরই এক স্বতন্ত্র ভূমি, এক বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রও— পূর্বতন কেন্দ্রীয় সরকার হইতে অর্থ কমিশন, সকলেই বলিয়াছে, তাহার উন্নয়ন হইতে হইবে দ্বীপবাসীদের জন্য, দ্বীপবাসীদেরই দ্বারা।
বর্তমান লক্ষদ্বীপ প্রশাসকের আচরণই বলিতেছে, তাঁহার দলের পদক্ষেপ জনমুখী নহে, উন্নয়নমুখীও নামেই, আসলে তাহা ক্ষমতামুখী। নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার হস্তগত বলিয়া শাসকের যথেচ্ছাচারই সেখানে নীতি, মানুষের কোনও মতামত নাই। শশী তারুর বলিয়াছেন, বিজেপি নির্বাচনে জিতিয়া লওয়া জায়গাগুলিকে ধ্বংস করে, আর যেগুলিকে বাগে আনিতে পারে না, সেগুলিকে ভাঙিতে বসে। প্রস্তাবিত পদক্ষেপ লইয়া খাস লক্ষদ্বীপেই বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যে গোল বাধিয়াছে, অন্য দিকে লক্ষদ্বীপকে ‘বাঁচাইতে’ আন্তর্জালে মুখর নাগরিকরা। লক্ষদ্বীপকে দ্বীপান্তর হইতে বাঁচাইতে এই প্রতিবাদ করিতেই হইবে।